মুসলিম জীবনে তাহাজ্জুদের নামাজ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ নফল ইবাদত। আল্লাহর বিষেশ নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো তাহাজ্জুদের নামজ। তাই নিয়ম মেনে তাহাজ্জুদের নামজ পরা উচিৎ। চলুন জেনে নেই তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম
তাহাজ্জুত নামজের রয়েছে অনেক ফজিলত এবং তাৎপর্য। কেননা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন। মহাগ্রহন্থ আল-কুরআন এবং হাদিসের অসংখ্য জায়গায় এর ফজিলত এবং তাৎপর্য বর্ণনা করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা আল-মুজাম্মিলের ১-২ নং আয়াতে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন-
يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ, قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا বাংলা অর্থ: হে চাদর আবৃতকারী! রাত্রিতে দন্ডায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে।
হাদিসে রাসুল (সঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাহালা ওই ব্যক্তির উপর রহমত নাজিল করেন, যিনি রাতে ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন এবং তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেন। অতঃপর তিনি (তার স্ত্রী) তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন। এমনকি যদি স্ত্রী ঘুম থেকে জাগ্রত হতে না চান, তাহলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেন। -আবু দাউদ ও নাসাঈ
এই নামাজ কি ও কেন পড়বো
তাহাজ্জুদ আরবী শব্দ। এর আবিধানিক অর্থ রাত্র জাগরণ বা নিদ্রা ত্যাগ। শরিয়তের পরিভাষায় রাতের শেষ ৩য় অংশে ঘুম থেকে উঠে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যে নামজ আদায় করা হয় তা-ই হলো ‘সালাতুত তাহাজ্জুদ’ বা তাহাজ্জুদ নামাজ।
রাতের শেষ ৩য় অংশে ঘুম থেকে ওঠে যে নামাজ আদায় করা হয় তাই মূলত তাহাজ্জুদের নামাজ। তাহাজ্জুদ একটি নফল ইবাদত। এই ইবাদত আল্লাহর নেককার ও উত্তম বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ প্রকৃত মুমিন আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় আন্তরিকতা ও গুরুত্বের সঙ্গে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন।
পবিত্র কোরআনে সুরা আস-সেজদাহ এর ১৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষনা করেছেন , “তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশঙ্কায়”।
এছাড়া মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেছেন যে, “রমজানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর নফলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নফল নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ”। (মুসলিম: ১১৬৩)
সুতারাং আমাদের সকলের উচিৎ নিয়ম মেনে আন্তরিকতা ও গুরুতবের সঙ্গে নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করা।
তাহাজ্জুদের নামাজের নিয়ম
তাহাজ্জুদ নামজের নিয়ম অন্যান্য নামাজের মতই। এখানে বিশেষ কোন নিয়ম নেই। অন্যান্য নফল নামাজের মতই এই নামাজ আদায় করতে হয়। তবে অন্যান্য নফল নামাজের মত তাহাজ্জুদ নামাজের সাধারণ নিয়ম গুলো হলো-
- তাকবীরে তাহরীমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামাজের নিয়ত করে হাত বাধা।
- ছানা পড়া, সূরা ফাতেহা পড়া।
- কেরাত পড়া তথা সূরা মিলানো। সম্ভব হলে বড় সূরা তেলাওয়াত করা।
- কেরাত উচু আওয়াজে বা চুপি চুপি পড়া যায়। উচু আওয়াজে পড়লে কারো ঘু্মের সমস্যা দেখা দেওয়ার আশংখা থাকলে চুপি চুপি পড়াই উত্তম।
- অন্যান্য নফল নামাজের মত রুকু ও সিজদা আদায় করা। আর রুকু/সিজদা দীর্ঘ করা উত্তম।
- ২য় রাকাত একইভাবে পড়া।
- শেষ বৈঠকে বসে তাশাহহুদ, দরুদ শরীফ ও দোয়া মাছুরা পড়া।
- সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করা।
- দুই দুই রাকাত করে এই নামজ পড়তে হয়।
সূরা ফাতেহার সাথে অন্য যে কোন সূরা মিলিয়েই তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা যায়। তাছাড়া তাহাজ্জুদ নামাজে লম্বা কেরাত তেলাওয়াত করা উত্তম। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যথাসম্ভব লম্বা কেরাত, লম্বা রুকু ও লম্বা সিজদা করতেন এবং এজন্য ওনার পা ফুলে যেত।
অতএব শেষ রাতের ৩য় অংশে ঘুম থেকে জেগে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় রুজু খুশু ভাব অবলম্বন করে অন্যান্য নফল নামজের নিয়মে দুই দুই রাকাত সালাত আদায় করা উত্তম। এক্ষেত্রে যথাসম্ভব লম্বা কেরাত ও রুকু সেজদাহ দীর্ঘ করাই উত্তম।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত
বিশেষ কোন নিয়তের বাধ্য বাধকতা নেই তাহজ্জুদ নামাজের। মনে মনে নিয়ত করলেই হয়ে যাবে। বাংলায় নিয়ত করতে চাইলে এভাবে করা যায়, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে কিবলামুখী হয়ে তাহাজ্জুদের দুই রাকাত নফল নামাজের নিয়ত করিলাম ।
আবার যদি কেউ আরবীতে নিয়ত করতে চায় তাহলেও করতে পারবে। তবে আরবী সঠিক উচ্চারণ না জানলে বাংলায় অথবা মনে মনে নিয়ত করাই উত্তম।
তাহাজ্জুদ নামজের সময়।
এশার নামাজের পর থেকে সুবহে সাদেকের আগ পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যায়। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার সবচেয়ে উত্তম সময় হচ্ছে রাতের এক তৃতীয়াংশের শেষ সময়। প্রত্যেক মানুষেরই উচিত এশার নামাজ পড়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাওয়া এবং মাঝরাতের পরে অর্থাৎ বাংলাদেশী সময় ২-৩ টায় উঠে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা।
আর যদি কেউ এশার নামাজের পর বিতরের আগে দুই রাকাত তাহাজ্জুদের নিয়ত করে নামাজ পড়ে তাহলেও তাহাজ্জুদের সাওয়াব পাবেন।
রাসুল (সঃ) সব সময় এশার নামজ পরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতেন অতঃপর মাঝ রাত্রের পর উঠতেন নামাজ আদায় করতেন। এর পর কখনো আবার ঘুমাতেন অথবা ফজরের নামাজ আদায় করতেন।
তাহাজ্জুদ নামাজের রাকাত সংখ্যা।
সালাতুল লাইল বা তাহাজ্জুদের নামজের কোন নির্দিষ্ট রাকাতের সংখ্যা নেই। তবে হাদিস থেকে জান যায় মহানবী (সঃ) ২ রাকাত, ৪ রাকাত,৮ রাকাত, ১২ রাকাত বা আরো বেশি পড়েছেন। তিনি বেশী পড়েছেন ৮ রাকাত। অতএব ৮ রাকাত পড়াই উত্তম। আপনি দুই রাকাত পড়লেও তাহাজ্জুদের সাওয়াব পাবেন।
আল্লাহ তায়ালার ঘোষনা-
অবশ্য রাতে ঘুম থেকে উঠা মনকে দমিত করার জন্য খুব বেশি কার্যকর এবং সে সময়ের কুরআন পাঠ বা জিকর একেবারে যথার্থ।(সূরা আল মুজাম্মিল)
তারা রাতের সামান্য অংশই নিদ্রায় অতিবাহিত করে এবং রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে।(সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত ১৭-১৮)।
আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।(সূরা আল ফুরকান, আয়াত-৬৪)।
হাদিসের ঘোষনা-
মহানবী হযরত মূহাম্মমদ (সঃ) এরশাদ করেন যে,
“মহান আল্লাহ তায়াল প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে (যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না) নেমে আসেন যখন রাত্রের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকে। অতঃপর তিনি ডেকে ডেকে বলেন, তোমাদের কে আছো যে আমাকে ডাকবে! আমি তার ডাকে সাড়া দেব। আর কে আছো আমার কাছে কিছু চাইবে আমি তাকে তা দেব। কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব”। (মুসলিম, মেশকাত ১০৯ পৃঃ)।
শষ কথা।
তাহাজ্জুদ নামাজ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করার অন্যতম মাধ্যম। দুনিয়ার সমস্ত মানুষ যখন আরামের ঘুমে বিভোর তখন যদি কোন আল্লাহর বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় নিজের ভুল ত্রুটি ক্ষমার জন্য রাতের ৩য় অংশে উঠে। অতঃপর দুই দুই রাকাত করে নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে দু চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে নিজের ভুল ত্রুটির ক্ষমা চায়, আল্লাহ তাহালা তা কবুল করে নেন। তাই আমাদের উচিৎ ভুল ত্রুটি ক্ষমা চাওয়ার মোক্ষম সময় হিসেবে রাতের শেষ ৩য় অংশ বেছে নেওয়া।