হেবা দলিল কি। হেবা দলিল বাতিলের নিয়ম

হেবা নিয়ে আমাদের সমাজে নানা মতবাদ রয়েছে এবং বিভিন্ন জন বিভিন্ন ধারনা পোষন করে। এর অন্যতম কারন, হেবা সম্পর্কে সঠিক ধারনা না থাকা। যা বাস্তবতার নিরিখে ভয়ংকর  এবং কখনো অপুরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমাদের জানা উচিৎ হেবা কি বা হেবা দলিল কি এবং হেবা দলিল বাতিল করার নিয়ম। আজকের আর্টিকেলটির মূল উদ্দেশ্য হেবা দলিল কি ও হেবা দলিল বাতিলের নিয়ম নিয়ে। চলুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেই, হেবা দলিল কি।

মুসলিম আইনে হেবার বিষয়ে রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু রীতি-নীতি এবং শর্ত। যেগুলো জেনে শুনে এবং পরিপালন না করে হেবা করলে তা যে কোন সময় বাতিল হয়ে যেতে পারে। তাই হেবা করার পূর্বে এর নিয়ম কানুন এবং শর্ত সমূহ জেনে হেবা করতে হবে।

হেবা কি।

যেহেতু আমাদের সমাজে হেবা নিয়ে নানা জনের নানা মতামত বা ধারনা রয়েছে। তাই ঐ সব বিব্রান্তি মূলক ধারনায় বিভ্রান্ত না হয়ে মুসলিম আইন অনুযায়ী হেবা কি এবং কাকে হেবা করা যাবে তা বিস্তারিত জানা জ্রুরী। সাথে সাথে আরো জানা থাকা দরকার হেবা বাতিল করা যায় কিনা। অথবা কিভাবে হেবা বাতিল করা যায়।

হেবা শব্দটি আরবী। এর শাব্দিক অর্থ দান। আর এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Gift।

মুসলিম আইনে কোন মুসলিম যদি অন্য কোন ব্যক্তি বা মুসলিমকে তার নিজের মালিকনা সম্পত্তি একান্ত ভালোবাসায় কোন রকম বিনিময় বা স্বার্থ ব্যতিরেখে স্ব-ইচ্ছায় দান করে থাকে, তাহলে ঐ দানকে হেবা বলে।

অন্যভাবে বললে বলা যায়, চাওয়া ও প্রতীক্ষা ছাড়া এক ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে কোন কিছুর বিনিময় ছাড়া কিছু দান করাকেই বলে হেবা ।

হিন্দু ও মুসলিম আইন ছাড়াও ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১২২ ধারায় দানের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এই আইন অনুযায়ী ”কোন সম্পত্তি দাতা কর্তৃক কোন ব্যক্তিকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে এর কোন পণ গ্রহণ না করে তাৎক্ষণিকভাবে হস্তান্তর করলে এবং গ্রহীতা বা তার পক্ষে কোন ব্যক্তি সেটি গ্রহণ করলে তাকে হেবা বা দান বলে”।

উক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম হেবা কি বা হেবা কাকে বলে। এবার জেনে নেই হেবা ঘোষনাপত্রের দলিল কি বা হেবা দলিল কি। চলুন জেনে নেই, হেবা দলিল কি।

হেবা দলিল কি।

পূর্বে হেবা মৌখিক ভাবে ঘোষনা দিলেই হতো। এখন আর শুধু মৌখিক ভাবে ঘোষনা দিলেই হবে না। এখন সরকারী ষ্ট্যাম্প আইন অনুযায়ী নির্ধারিত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে হেবা ঘোষনাটি লিখে দালিলিক রুপে নির্ধারিত সাব-রেজিস্ট্রারী অফিসে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এই রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াই হেবা দলিল।

দলিল সম্পাদনের পর তা সরকার নির্ধারিত ফি প্রদান স্বাপেক্ষে রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হবে। ২০০৫ সালের ১ জুলাই হতে হেবা দলিল রেজি: বাধ্যতামূলক করা হয়। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া হেবা দলিলের কায়েমী স্বার্থ দাবী করা যাবে না।

হেবা দলিলের শর্ত।

হেবা দলিলের মৌলিক ৩টি শর্ত রয়েছে। যেগুলো পরিপালন না করে হেবা করলে হেবা দলিল বাতিল বলে গন্য হবে। হেবা দলিলের শর্ত ৩(তিন)টি হলো-

  • দাতা কর্তৃক হেবা বা দানের ঘোষণা বা প্রস্তাব করতে হবে ।
  • যিনি হেবা বা দান গ্রহীতা বা গ্রহন করবেন তার কর্তৃক উহা গ্রহণ করা।
  • দাতা কর্তৃক হেবাগ্রহীতাকে হেবার সম্পত্তি দখল প্রদান করতে হবে।

এই শর্তগুলো যদি পালন করা হয়, তাহলে হেবাটি আইনানুগভাবে সিদ্ধ হবে ।

কে কাকে হেবা করতে পারবে।

নিম্মে রক্ত সম্পর্কীয় ব্যক্তিদের মাঝে কোন বিনিময় মূল্য ছাড়া হেবা করা যাবে। যথা-

  • সহোদর বা আপন ভাই-বোন একে অপরকে হেবা করতে পারবে।
  • পিতা/মাতা তার ছেলে/মেয়েকে হেবা করতে পারবে।
  • স্বামী-স্ত্রী এর মধ্যে হেবা করা যাবে। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে হেবা করতে পারবে।
  • দাদা/দাদী-নাতী/নাতনীর মধ্যে হেবা করা যাবে।
  • নানা/নানী-নাতী/নাতনীর মধ্যে হেবা করা যাবে।

উপরের এই কয়েকটি সম্পর্কের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তর করা যায়।

মোট কথা, একজন মুসলিম তার সমগ্র ভূ-সম্পত্তি যেকোনো ব্যক্তি হোক সে অমুসলিম বরাবরও হেবা বা দান করতে পারেন। অর্থাৎ গৃহীতার ক্ষেত্রে সাবালক, নাবালক, পুত্র, অপুত্র, স্বামী কিংবা স্ত্রী, ধনী-নির্ধন বালাই নেই, যে কাউকে দান করা যায় এবং তিনি বা তারা নির্বিবাদে দান গ্রহণ করতে পারেন।

উল্লেখ্য যে, উপরের রক্ত সম্পর্কের ১৫ ব্যক্তির বাহিরে অন্য কাউকে হেবা করলে সেটা আর বিনিময় ছাড়া হবে না। বিনিময় নিয়ে করতে হবে। অর্থাৎ সাবকবলার ন্যায় করতে হবে। অন্যথায় ঐ হেবা বাতিল হয়ে যাবে।

হেবার প্রকারভেদ।

এতো সময় আমরা জানলাম, হেবা দলিল কি এবং শর্ত ও কে কাকে হেবা করতে পারবে। এখন আমরা জানবো হেবা কত প্রকার এবং কি কি?

হেবা প্রধানত দুই প্রকার। যথা-

  1. সাধারণ হেবা।
  2. হেবা-বিল-অ্যাওয়াজ।

সাধারণ হেবা।

যে হেবায় আদৌ কোন প্রতিদান বা বিনিময় নেই এবং সম্পত্তি দাতা দ্রুত সময়ে গ্রহিতার কাছে তার দখলকৃত সম্পত্তি হস্তন্তর করাকে সাধারন হেবা বলে। আর এই হেবা উপরের ১৫ জন রক্ত সম্পর্কের ব্যক্তির মধ্যে হতে হবে। কেননা উক্ত রক্ত সম্পর্কের ব্যক্তির বাহিরে হেবা করলে তখন আর সাধারন হেবা থাকে না।

হেবা-বিল-অ্যাওয়াজ।

হেবা-বিল-অ্যাওয়াজ হলো সম্পত্তির মূল্যের পরিশধের বিনিময়ে হেবা। অর্থাৎ বিনিময় বা মূল্যের দ্বারা হেবা করা। হেবার ক্ষেত্রে এটি একটি বিশেষ ব্যতিক্রম বটে । এই হেবাকে বৈধ করতে হলে ২ (দুটি) শর্ত অবশ্যই পালন করতে হবে।

  1.  দান গ্রহিতা কর্তৃক হেবা-বিল-অ্যাওয়াজ এর বিনিময় মূল্যে প্রকৃ্ত ও বাস্তব অর্থেয় দিতে হবে ।
  2.  দাতার মালিকানা পরিত্যাগকরত দান করার আন্তরিক অভিপ্রায় বা ইচ্ছা ব্যক্ত করতে হবে।

আরো জানুনঃ

হেবা দলিল বাতিল করার নিয়ম

বাংলাদেশের প্রতিকার আইন অনুযায়ী হেবা দলিল রেজিস্ট্রেশন করার সময় হেবার যাবতীয় শর্ত পূরন করে হেবার ঘোষনাপত্র দলিল তৈরী করা হয়। তাই হেবা ঘোষনাপত্র দলিলে দাতা কর্তৃক তফসিল বর্ণিত সম্পত্তি মৌখিকভাবে হেবা করতঃ গ্রহিতার বরাবর হেবার সম্পত্তির দখল অর্পণ এবং হেবা গ্রহিতা কর্তৃক তা গ্রহনের কথা স্পস্টভাবে উল্লেখ থাকে।

এছাড়া উক্ত দলিলে দাতা এবং গ্রহিতা উভয়েরই স্বাক্ষর  এবং সাক্ষীগণের স্বাক্ষর ও সনাক্তকারীর নাম স্বাক্ষর থাকায় দখল-অর্পণ এর কথা কখনো অস্বীকার করার সুযোগ থাকে না।

এমতাবস্থায় হেবার ঘোষনাপত্র দলিল বাতিলের কোন আইনগত সূযোগ নেই।

তারপরও যদি উপসুক্ত ও যুক্তিসংগত কারনে হেবার ঘোষনাপত্র দলিল বাতিল করতে হয়, তাহলে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। অর্থাৎ আদালতের মাধ্যমে বাতিল করা যাবে।

হেবা দলিল কখন বাতিল করা যায়।

দাতা কর্তৃক গ্রহীতাকে দখল প্রদানের আগে যে কোনো পর্যায়ে হেবা দলিল বাতিল করা সম্ভব। কারণ হেবার তিনটি শর্তের মধ্যে অন্যতম শর্ত হচ্ছে দখল হস্তান্তর করা। দখল হস্তান্তর না করলে হেবা সম্পূর্ণ হয় না।  তবে কিছু ক্ষেত্রে হেবা দলিল বাতিল চাওয়া যায়। যেমন,

  • দাতা বা সম্পত্তির মালিকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর পূর্বক হেবা করতে বাধ্য করলে।
  • যে কোন রকম ভয়-ভীতি বা প্রলোবন দেখিয়ে হেবা দলিল সম্পাদন করলে।
  • দাতা মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত অথবা অসুস্থ থাকা অবস্থায় কৌশলে হেবা দলিল করলে।
  • উপরে বর্ণিত হেবা দলিলের ৩টি শর্তের যে কোন একটি পালনে ব্যর্থ হলে।
  • হেবার সম্পত্তি হস্তান্তরের বা দখল দানের আগে দাতার মানসিকতা পরিবর্তন হলে।
  • দখল হস্তান্তরের আগে দাতা-গ্রহীতার যে কেউ একজন মারা গেলে।
  • হেবার সম্পত্তি দাতার দখলে না থাকলে।

তবে, কিছু কিছু অবস্থার প্রেক্ষিতে হেবা দলিল বাতিল করা যাবেনা ।

কখন হেবা দলিল বাতিল করা যাবে না।

  • হেবার দাতা-গ্রহীতা সম্পর্কে স্বামী বা স্ত্রী হইলে।
  • দখল হস্তান্তরের পর গ্রহীতা মারা গেলে।
  • দাতা-গ্রহীতা উভয়ের মধ্যে বিবাহ অযোগ্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকিলে।
  • গ্রহীতা কর্তৃক হেবার সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করে ফেললে।
  • সম্পত্তি বিলীন বা ধ্বংস অথবা সম্পত্তির আকার সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেলে।
  • হেবাকৃত সম্পত্তির দাম আকস্মিক বেড়ে গেলে।

দান বা হেবা দলিল বাতিলের পদ্ধতি।

কারো মুখের কথায় অথবা গায়ের জোরে হেবা দলিল বাতিল করা যায় না। হেবা দলিল বাতিল করতে হবে আদালতের মাধ্যমে।

আদালতে দলিল বাতিলের জন্য মামলা দায়ের করলে, আদালত মামলার বিষয়বস্তুর গুনগত মান বিবেচনা করে যৌক্তিক মনে করলে উক্ত হেবা দলিল বাতিল করতে পারেন।

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারা অনুযায়ী, যে কোনো ব্যক্তি হেবা দলিল বাতিল চেয়ে বা বাতিল যোগ্য, যার যুক্তিসঙ্গত আশংকা আছে যে, এই জাতীয় লিখিত দলিল থেকে গেলে তা তার গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে, তাহলে তিনি উক্ত লিখিত দলিল বাতিল বা বাতিলযোগ্য ঘোষণা চেয়ে মামলা করতে পারেন।

উক্ত মামলার ভিত্তিতে আদালত তার ইচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে যাচাই-বাছাই করে যুক্তিসংগত কারণ মনে করলে বাতিল করার আদেশ দিতে পারেন।

এছাড়া নিম্মোক্ত কারনে আদালতের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বলে বাতিলের আদেশ দিতে পারেন।

  • আদালত যদি মনে করেন যে, উক্ত দলিল বাদীর জন্য ক্ষতিকর।
  • প্রকৃতই প্রতারণার মাধ্যমে উক্ত দলিল সম্পাদন বা রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে।
  • হেবার সকল শর্ত মানা হয়নি।
  • হেবা দলিল সম্পাদন করার সময় সরকারী যে কোন স্বার্থ রক্ষা করা হয়নি।

এসব কারনে হেবা দলিল আদালত বাতিলের আদেশ দিতে পারেন।

আর যদি মনে হয় যে, শুধুমাত্র হয়রানি করার উদ্দেশ্য বা প্রতারণার কিছুই ছিল না এখানে, তাহলে দলিল বাতিলের আদেশ দিবেন না। এখানে আদালতের পুরো ক্ষমতাই হচ্ছে ইচ্ছাধীন, আদালতকে বাধ্য করা যাবে না কোন নির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়ার জন্য।

আরো জানতে ক্লিক ক্রুনঃ

শেষ কথা।

আবেগ দিয়ে কোন কিছু হয়না। আবার জোর খাটিয়েও কোন কিছু করা যায়না। তাই কোন কাজ করার আগে আবশ্যই ভাবতে হবে এবং জানতে হবে নিয়ম কানুন। তাই হেবা করার আগে জানতে হবে হেবা দলিল কি। কিভাবে করতে হয় হেবা দলিল। আপনার যদি জানা থাকে হেবা করার নিয়ম কানুন, তাহলে বাতিলের নিয়মও জানা যাবে।

আশা করি উপরের আর্টিকেলটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লে আপনি উক্ত সমস্যা তথা জানতে পারবেন হেবা দলিল কি। হেবা দলিল বাতিল করার নিয়ম।

About Author

AMINUL ISLAM

মোঃ আমিনুল ইসলাম। পেশায় একজন ব্যাংকার। চাকরির পাশাপাশি লেখা লেখির অভ্যাস থেকে ব্লগিং করা। এই ব্লগে বিভন্ন প্রযুক্তি , সরকারি সেবা, ব্যাংকিং, আইন ও নিয়ম কানুন, এবং ইসলামিক সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করেছি।

Leave a Comment