জমি বন্ধক রাখার নিয়ম

জমি বন্ধক আমাদের দেশে একটি প্রচলিত এবং সুপরিচিত শব্দ। অনেকেই জানতে চান জমি বন্ধক রাখার নিয়ম সম্পর্কে। তাদের জন্যই আজকের এই আর্টিকেলটি। আজ আমরা আলোচনা করবো জমি বন্ধক রাখার নিয়ম বা বৈধ/অবৈধ সম্পর্কে। চলুন বিস্তারিত ভাবে জেনে নেই, জমি বন্ধক রাখার নিয়ম

বন্ধক বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন , বন্ধক, রেহান, কট, মারকিচ, মর্টগেজ ইতাদি। যে এলাকেয় যে নামেই বলুকনা কেন মুল শব্দ বন্ধক। মুলত সকলের জানার বিষয় হলো বন্ধক রাখার নিয়ম এবং বন্ধক বৈধ বা জায়েজ কিনা। বিশেষ করে মুসলিম সমাজে অবশ্যই জানা উচিৎ বন্ধক বৈধ বা জায়েজ কিনা অথবা ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধক হালাল না হারাম।

জমি বন্ধক কি?

জমি বা Land কি তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু বন্ধক শব্দটির সাথে আমাদের পরিচয় থাকলেও বন্ধক কাকে বলে এ বিষয় সম্পর্কে অনেকেই জানিনা। তাই আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় জমি বন্ধক রাখার নিয়ম সম্পর্কে।

বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কোন ঋণ বা অগ্রিম অর্থ পরিশোধের জামিন গ্রহণ করা অথবা যে কাজ সম্পন্নে আর্থিক দায়িত্ব রয়েছে, তার জামিন গ্রহণ করা বন্ধক এবং যে দলিলের মাধ্যমে উক্ত বন্ধক প্রদান বা গ্রহণ সম্পন্ন হয়, তাকে বন্ধকনামা বলে।

অথবা কোন ব্যক্তি বিশেষ প্রয়োজনে অন্য কোন ব্যক্তি থেকে কিছু টাকা ঋণ নিলো, ঋণের বিনিময়ে জামানত স্বরূপ এক খন্ড জমি ঋণ দাতার নিকট যে পদ্ধতিতে রাখা হয় তাকে জমি বন্ধক বলে।

জমি বন্ধক রাখার নিয়ম

আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় জমি বন্ধক দিয়ে নিয়ে থাকে। জমি বন্ধককে আমরা দুইভাবে ভাগ করতে পারি। যথা-

  1. সাধারন প্রচলিত নিয়মে জমি বন্ধক।
  2. ইসলামের দৃষ্টিতে জমি বন্ধকের নিয়ম।।

সাধারন প্রচলিত নিয়মে জমি বন্ধক।

আমাদের দেশে জমি বন্ধক দেওয়া-নেওয়ার সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো কোনো ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে অন্য কারও কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি বন্ধক নিয়ে থাকে। সাধারণত কত বছরের জন্য বন্ধক নেওয়া হয় তাহা উল্লেখ থাকে না।

এখানে যতোদিন জমির মালিক টাকা ফেরত দিতে না পারবে ততোদিন  টাকাদাতা জমি ভোগ করতে থাকে। এভাবে দু-চার বছর চলে যায়। এরপর জমির মালিক টাকাদাতার মূল টাকা ফিরিয়ে দিয়ে নিজের জমি ফিরিয়ে নেয়।

এছাড়া সমাজে আরো একটি নিয়ম রয়েছে। যেমন কোনো ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে অন্য কারও কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি বন্ধক নিয়ে থাকে। যখন জমির মালিক টাকাদাতাকে তার টাকা ফেরত দেন তখন যত বছর ঋণ দাতা জমি ভোগ করেছেন প্রত্যেক বছরে ৫০০-১০০০ টাকা কম নেয় বা দেয়।

উপরের দুটি প্রচলিত নিয়ম মুলত একই রকম। মাত্র সামান্য পার্থক্য রয়েছে। এখানে সামান্য যে টাকা কম নেয়া হচ্ছে তাহা সম্পূর্ণ ঋণ দাতার ইচ্ছা মাফিক। এখানে ঋণ গ্রহিতার কোন প্রভাব থাকে না।

মূলত উপরের প্রচলিত দুটি নিয়মই ইসলামের দৃষ্টিতে সুদের পর্যায় পরে,যাহা সম্পূর্ণ হারাম। বন্ধক দেয়া-নেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে অবশ্যই বৈধ বা জায়েজ। কিন্তু এর জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম। যাহা সকলের মানতে হয়।

ইসলামের দৃষ্টিতে জমি বন্ধক রাখার নিয়ম

ইসলামের দৃষ্টিতে জমি বন্ধক রাখা বৈধ বা জায়েজ । তবে বর্তমানে সমাজের প্রচলিত রীতিতে যে ভাবে জমি বন্ধক রাখা হয় সেটা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। নিম্মে কুরআন ও হাদিসের আলোকের জমি বন্ধক বিষয়ে জানবো।

কুরআনের আলোকে বন্ধক রাখার নিয়ম

পবিত্র কুরআনের ২য় সুরা আল বাকারর ২৮৩ নং আয়াতে বন্ধকি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন।

وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ عَلٰی سَفَرٍ وَّ لَمۡ تَجِدُوۡا کَاتِبًا فَرِهٰنٌ مَّقۡبُوۡضَۃٌ ؕ فَاِنۡ اَمِنَ بَعۡضُکُمۡ بَعۡضًا فَلۡیُؤَدِّ الَّذِی اؤۡتُمِنَ اَمَانَتَهٗ وَ لۡیَتَّقِ اللّٰهَ رَبَّهٗ ؕ وَ لَا تَکۡتُمُوا الشَّهَادَۃَ ؕ وَ مَنۡ یَّکۡتُمۡهَا فَاِنَّهٗۤ اٰثِمٌ قَلۡبُهٗ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ عَلِیۡمٌ

অর্থাৎ  “আর তোমরা যদি প্রবাসে থাকো এবং কোনো লেখক না পাও, তবে (ঋণের মোকাবিলায়) বন্ধকি বস্তু হস্তগত করে রাখা উচিত। যদি একে অন্যকে বিশ্বাস করতে পারো। তবে যাকে বিশ্বাস করা হয়, তার উচিত অন্যের প্রাপ্য পরিশোধ করা এবং স্বীয় পালনকর্তাকে ভয় করা। তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে কেউ তা গোপন করবে, তার অন্তর গোনাহপূর্ণ হবে। তোমরা যা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত”।সুরা বাকারা : ২৮৩

পবিত্র কুরআনের আয়াতের আলোকে জানা গেলো যে বাকীর ব্যাপারে কেউ যদি বিশ্বস্ততার জন্য কোন বস্তু বন্ধক নিতে চায়, তাও করতে পারে। কিন্তু  বন্ধকী বস্তু দ্বারা উপকৃত হওয়া তার জন্য জায়েয নয়। সে শুধু ঋণ পরিশোধ হওয়া পর্যন্ত একে নিজের অধিকারে রাখবে। এর যাবতীয় মুনাফা আসল মালিকের প্রাপ্য।

সুরা বাকারার উল্লিখিত আয়াত থেকে বোঝা যায়, বন্ধককৃত বস্তু-সামগ্রী অথবা জমি বন্ধক গ্রহীতার কাছে আমানতস্বরূপ। সুতরাং,বন্ধক নেওয়া জমি থেকে বন্ধকগ্রহীতার কোনো ফায়দা হাসিল করা যেমন ফসল উৎপাদন করা ইত্যাদি নাজায়েজ ও হারাম। এমনকি বন্ধকদাতা অনুমতি দিলেও এমনটি করা যাবে না।

হাদিসের আলোকে বন্ধক রাখার নিয়ম

বন্ধকের বৈধতা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে বক্তব্য রয়েছে। যেমন- নবী করিম (সা.) নিজেও বন্ধক সুবিধা গ্রহণ করেছেন।

“হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী করীম (সা.) এক ইহুদির কাছ থেকে বাকিতে (নির্দিষ্ট সময়ে মূল্য পরিশোধের শর্তে) কিছু খাদ্য পন্য ক্রয় করেছেন, অতঃপর মূল্যের জামিন হিসাবে নিজ বর্মকে বন্ধক রেখেছেন”। সহিহ বুখারী-২৫০৯।

ইমাম  ইয়াহিয়া আন নববী  (রহ.) এই হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই হাদিস দ্বারা বন্ধকের বৈধতা প্রমাণিত হয়। এমনকি কাফের বা অমুসলিমের কাছেও যুদ্ধাস্ত্র বন্ধক রাখার বৈধতাও প্রমাণিত হয়।

এছাড়া অন্য হাদিসে এসেছে-

“ইবনে সিরিন (রহ.) বলেন, জনৈক ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করল, ‘এক ব্যক্তি আমার কাছে একটি ঘোড়া বন্ধক রেখেছে, আমি তা আরোহণের কাজে ব্যবহার করেছি।’ ইবনে মাসউদ (রা.) এ কথা শুনে বললেন, ‘তুমি আরোহণের মাধ্যমে এর থেকে যে উপকার লাভ করেছ তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে”।

বিখ্যাত তাবেঈ কাজি শুরাইহ (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘সুদ পান করা হয় কীভাবে? তিনি উত্তরে বললেন, বন্ধকগ্রহীতা বন্ধকি গাভির দুধ পান করলে তা সুদ পান করার অন্তর্ভুক্ত হবে।’

উপরের কুরআন ও হাদিসের আলোকে জানা গেলো বন্ধক দেয়া নেয়া বৈধ বা জায়েজ। এব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিতে কোন বাদা নেই। এমনকি অমুসলিদের সাথেও বন্ধক দেয়া নেয়া যাবে। তবে বন্ধক নেওয়া জমি থেকে বন্ধকগ্রহীতার কোনো ফায়দা হাসিল করা যেমন ফসল উৎপাদন করা ইত্যাদি নাজায়েজ ও হারাম। এমনকি বন্ধকদাতা অনুমতি দিলেও এমনটি করা যাবে না।

তাই জমি জমা সহ যে কোন বৈধ  স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক দেওয়া যাবে। যেহেতু প্রচলিত পদ্ধতিতে ইসলামের দৃষ্টিতে জমি বন্ধক দেয়া নেয়া জায়েজ নেই সেহেতু ইসলামের এর জন্য সুন্দর একটি বিকল্প পদ্ধতি বাতলে দিয়েছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে জমি বন্ধক রাখার নিয়ম।

জমি যখন কোন ব্যক্তির কাছে বন্ধক রাখা হয় এবং ঐ বন্ধকী জমি থেকে টাকা দাতা উপকৃত বা লাভবান হতে চাইলে জমি বন্ধকী চুক্তি বাতিল করতে হবে। বন্ধকী চুক্তি বাতিল করে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা তথা ভাড়া নেওয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

অর্থাৎ যত দিন পর্যন্ত ঋণের টাকা পরিশোধ না হয় ঋণদাতা জমিটি ইজারা বা ভাড়া পদ্ধতিতে জমির ফসল বা অন্যান্য সুবিদা ভোগ করবে এবং তার ন্যায্য ভাড়াও জমির মালিককে দিয়ে দেবে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে আমরা দেখাতে পারি।

যেমন জনাব আব্দুর রহমান সাহেবের বিশেষ প্রয়োজনে কিছু টাকার প্রয়োজন। তিনি আব্দুস সালাম সাহের কাছে গেলেন এবং বললেন যে, আমার জমিটি আপনি ভাড়া নিন বিনিময় আমাকে ২৪,০০০/-টাকা অগ্রম দিন। যেই জমির ভাড়া নির্ধারণ করা হলো মাসে ২০০০/-টাকা।

আব্দুস সালাম সাহেব রাজি হয়ে আব্দুর রহমান সাহেবকে ২৪০০০/- অগ্রিম দলেন এবং ২৪ মাস বা দুই বছর জমি ভোগ করলেন। দুই বছর পর আব্দুস সালাম সালাম সাহেব আব্দুর রহমান সাহেবের জমি ফেরত দিয়ে দলেন।

এখানে যেহেতু অগ্রিম টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে সেহেতু ভাড়া দুই জনের সম্মতিতে কম বেশি নির্ধারিত হতে পারে। তাতে সমস্যা নেই । তবে ইজারা বা ভাড়া ভিত্তিতে জমি বন্ধক দেওয়া হলে চুক্তি দুটি ভিন্ন ভিন্ন হতে হবে। একটি আরেকটি শর্ত হিসেবে দেওয়া যাবে না।

ইজারা কি?

ইজারা শব্দের অর্থ ভাড়া দেওয়া। যেকোনো মেয়াদে জমি ইজারা তথা ভাড়া দেওয়া নেওয়া বৈধ। তবে জমি ভাড়া এমনভাবে  উপকার লাভ করতে হবে, যাতে জমির উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ক্ষতি বা জমির আকৃতির কোন পরিবর্তন না হয়।

তবে যদি ইজারাদারকে জমির মালিক সাধারণভাবে যেকোনো ফসল চাষ বা ঘর বাড়ি/স্থাপনা করার অনুমতি দেন, তবে সে তা করতে পারবে। তবে গাছসহ বাগান ইজারা দেওয়া জায়েজ নয়।

শেষ কথা।

আমাদের দেশে যে নিয়মে জমি বন্ধক দেয়া নেয়া হয় তা ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েজ নয় এবং হারাম। কিন্তু কুরআন হাদিসের আলোকে জমি বন্ধক দেয়া নেয়া জায়েজ। তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই কিছু নিয়ম অবলম্বন করতে হবে।

About Author

AMINUL ISLAM

মোঃ আমিনুল ইসলাম। পেশায় একজন ব্যাংকার। চাকরির পাশাপাশি লেখা লেখির অভ্যাস থেকে ব্লগিং করা। এই ব্লগে বিভন্ন প্রযুক্তি , সরকারি সেবা, ব্যাংকিং, আইন ও নিয়ম কানুন, এবং ইসলামিক সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করেছি।

Leave a Comment