ওয়ারিশ সম্পদ বন্টনের আইন সম্পর্কে আমাদের অনেকের জানা নেই। যার কারনে আমাদের কেউ মারা গেলে তার সম্পদ নিয়ে অনেক ঝামেলা দেখা দেয়। যাদের ওয়ারিশ বা উত্তারাধিকার সম্পদ বন্টনের আইন সম্পর্কে ধারণা নেই তাদের জন্য আজকের এই লেখাটি। চলুন জেনে নেই ওয়ারিশ সম্পদ বন্টনের আইন
ওয়ারিশ আরবী শব্দ। এর অর্থ উত্তারাধিকারী। মুসলিম পারিবারিক আইনে কোন ব্যাক্তি মারা যাওয়ার সময় যাদেরকে রেখে যান অথবা যারা মৃত ব্যাক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ পাওয়ার যোগ্য তাদেরকে ওয়ারিশ বা উত্তারাধিকারী বলে। যেমন কোন ব্যাক্তি মারা যাওয়ার সময় পিতা, মাতা, স্ত্রী, সন্তান ইত্যাদি রেখে যান, তাদেরকে মৃত ব্যাক্তির ওয়ারিশ বা উত্তারাধিকারী বলে।
মৃত ব্যাক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ/অর্থ তার দাপন কাপনের খরচের পর যা বাকী থাকে এবং যেটা তার ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন করা হয় সেটাকে ওয়ারিশ সম্পদ বলে। মনেকরি আব্দুল করিম সাহেব মারা যাওয়ার সময় ১০ শতাংশ জমি ও বসত বাড়ি রেখে গেছেন। সাথে সাথে আব্দুল করিম সাহেবের পিতা, মাতা, স্ত্রী, সন্তান সহ আরো কিছু আত্নীয় রেখে গেছেন। এই যে সম্পদ রেখে গেছেন সেটা হলো তার রেখে যাওয়া পিতা, মাতা, স্ত্রী, সন্তানদের সম্পদ বা ওয়ারিশ সম্পদ।
উত্তারাধিকার বা ওয়ারিশ সম্পদ বন্টনের আইন
মুসলিম পারিবারিক আইনের প্রধান উৎস হলো-কোরআন, হাদিছ, ইজমা, কিয়াস। পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ৭ম, ৮ম,১১তম আয়াতের মাধ্যমে ওয়ারিশ সম্পদ বন্টনের আইন বা নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত বলে হয়েছে।
যেমন সূরা নিসার ১১তম আয়াতে আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে বিস্তারিত বলে দিয়েছেন-
আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক ছেলের জন্য দুই মেয়ের অংশের সমপরিমাণ। তবে যদি তারা দুইয়ের অধিক মেয়ে হয়, তাহলে তাদের জন্য হবে, যা সে রেখে গেছে তার তিন ভাগের দুই ভাগ; আর যদি একজন মেয়ে হয় তখন তার জন্য অর্ধেক।আর তার মাতা পিতা উভয়ের প্রত্যেকের জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ সে যা রেখে গেছে তা থেকে, যদি তার সন্তান থাকে। আর যদি তার সন্তান না থাকে এবং তার ওয়ারিছ হয় তার মাতা পিতা তখন তার মাতার জন্য তিন ভাগের এক ভাগ। আর যদি তার ভাই-বোন থাকে তবে তার মায়ের জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ।অসিয়ত পালনের পর, যা দ্বারা সে অসিয়ত করেছে অথবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের মাতা পিতা ও তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্য থেকে তোমাদের উপকারে কে অধিক নিকটবর্তী তা তোমরা জান না। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়
সুতারাং যে নির্দিষ্ট আইন দ্বারা মৃতের সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন করা হয় তাকে উত্তরাধিকার আইন বলে।
অথবা কুরআনে বর্ণিত আইনের আলোকে মৃতের সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন করার নিয়ম কে ওয়ারিশ সম্পদ বন্টনের আইন বলে।
ওয়ারিশ বা উত্তারাধিকারী কয় প্রকার।
মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে ৩ শ্রেনীর ওয়ারিশ বা উত্তারাধিকারী আছে। যেমন-
- অংশীদার।
- অবশিষ্টাংশ ভোগী।
- দূরবর্তী আত্মীয়বর্গ।
এখন আমরা জানবো অংশীদার, অবশিষ্টাংশ ভোগী, দূরবর্তী আত্মীয়বর্গ কারা বা কাদেরকে অংশীদার, অবশিষ্টাংশ ভোগী, দূরবর্তী আত্মীয়বর্গ বলে।
অংশীদারঃ
যে ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের অংশ কোরআনে নির্দিষ্ট করা হয়েছে বা বর্ণিত হয়েছে তারাই অংশীদার। পবিত্র কোরআনের সুরা নিসার ১১ তম আয়াতে ১২ জন মোট ১২ জন ওয়ারিশ বা অংশীদারের কথা আছে। তাদের ৪ জন পুরুষ এবং ৮ জন নারী। এরাই হলো অংশীদার।
অবশিষ্টাংশ ভোগীঃ
কোরআনে বর্ণিত নির্দিষ্ট অংশীদারদের মধ্সযে সম্পত্তি বন্টনের পর মৃতের সাথে যাদের রক্তের সম্পর্ক রয়েছে তারাই হল অবশিষ্টাংশ ভোগী। অথবা মৃত ব্যাক্তির সম্পত্তি তার অংশীদারদের মধ্যে বন্টনের পর অবশিষ্ট সম্পত্তিতে যাদের অধিকার রয়েছে তারাই অবশিষ্টাংশ ভোগী।
দূরবর্তী আত্মীয়বর্গঃ
যাদের সাথে মৃতে ব্যক্তির রক্তের সম্পর্ক রয়েছে কিন্তু তারা অংশীদার বা অবশিষ্টাংশভোগী নয় তারাই মৃতের দূরবর্তী আত্মীয়বর্গ। যদি মৃতের অংশীদার এবং অবশিষ্টাংশ ভোগী ওয়ারিশ না থাকে তাহলেই কেবল মৃতের দূরবর্তী আত্মীয়বর্গ সম্পত্তি পাবেন।
সম্পদ বন্টনের আইনে ওয়ারিশ কয়জন।
ওয়ারিশ সম্পদ বন্টন আইনে মোট ১২ জন ওয়ারিশ বা অংশীদার আছেন। তাদের ৪ জন পুরুষ এবং ৮ জন নারী।
- পিতা
- মাতা
- স্মামী
- স্ত্রী
- কন্যা
- দাদা
- পুত্রের কন্যা
- দাদী বা নানী
- আপন বোন
- বৈমাত্রয় বোন
- বৈপিত্রেয় ভাই
- বৈপিত্রেয় বোন।
উপরের ওয়ারিশ গনের মধ্যে নিচের ৬ জন কখনো বা কোন অবস্থায়ই উত্তরাধিকার হতে বাদ দেয়া যাবে না।
- পিতা
- মাতা
- ছেলে
- মেয়ে
- স্বামী
- স্ত্রী
ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পদ বন্টনের নিয়ম
এখানে আমরা একটি উদাহরণের মাধ্যমে ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পদ বন্টনের নিয়ম বুঝার চেষ্টা করবো। ধরি, আব্দুল করিম সাহেব মারা যাওয়ার সময় ১০ শতাংশ জমি ও বসত বাড়ি রেখে গেছেন। সাথে সাথে আব্দুল করিম সাহেবের পিতা, মাতা, স্ত্রী, সন্তান সহ আরো কিছু আত্নীয় রেখে গেছেন। এই যে সম্পদ রেখে গেছেন সেটা হলো তার রেখে যাওয়া পিতা, মাতা, স্ত্রী, সন্তানদের সম্পদ বা ওয়ারিশ সম্পদ। এখন আমরা এই সম্পদ দুই ভাবে বন্টন করতে পারি।
- মুসলিম ফারায়েজ ক্যালকুলেটর ওয়েবসাইট ব্যবহার করে।
- ম্যানুয়াল হিসাবের মাধ্যমে।
মুসলিম ফারায়েজ ক্যালকুলেটর।
এই ওয়েবসাইটি ব্যবহার করে সহজেই এক মিনিটে মৃত ব্যক্তির সম্পদের হিসাব বের করা যাবে। প্রথমে আপনাকে প্রবেশ করতে হবে উত্তারাধিকার. বাংলা এই ওয়েবসাইটে। এখানে প্রবেশ করার সাথে সাথে নিচের পেইজটি আপনার সামনে চলে আসবে।
এখানে আব্দুল করিম সাহেব মারা যাওয়ার সময় কোন কোন ওয়ারিশ রেখে গেছেন তাদের পাশের বক্সে টিক চিহ্ন দিন। ধরি ওয়ারিশদের মধ্যে রয়েছে-পিতা, মাতা, স্ত্রী, এক মেয়ে,ও দুই ভাই। আত্মীয়-স্বজনের তালিকা অংশে তাদের প্রত্যেকের বক্সে টিক চিহ্ন দিয়ে নিচের সম্পদের বিবরণ অংশে চলে আসুন।
এখানে রয়েছে জমি, স্বর্ণ, রৌপ্য, মুদ্রা। জমির অংশে মোট জমির হিসাব শতাংশে, স্বর্ণ-রৌপ্য ভরি হিসাবে এবং মুদ্রার হিসাব টাকায় করতে হবে। আব্দুল করিম সাহেব মাত্র ১০ শতাংশ জমি রেখে গেছেন । তাই জমি ঘরে ১০ শতাংশ বসিয়ে একেবারে নিচের ফলাফল বাটনে ক্লিক করতে হবে। ফলাফল বাটনে ক্লিক করলেই নিচের মতো পেইজে আপনার সম্পদের হিসাবের তথ্য দেখতে পাবেন।
আরো জানুনঃ
ম্যানুয়াল হিসাবের মাধ্যমে।
ওয়ারিশ সম্পদ বন্টনের আইনে পিতা,মাতা,ছেলে,মেয়ে,স্বামী,স্ত্রী কে কত অংশ পাবে তাহা নিম্মে বর্ণনা করা হলো।
পিতার অংশঃ
মৃত ব্যক্তির পিতা ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকার লাভে তিন অবস্থায় পড়তে পারেন-
- মৃত ব্যক্তির কোন পুত্র বা পুত্রের পুত্র, যত নিম্নেরই হউক, যদি থাকে তাহলে বাবা ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬) পাবেন।
- যদি মৃতের পুত্র, পুত্রের পুত্র না থাকে কিন্তু কন্যা, পুত্রের কন্যা থাকলে বাবা ছয় ভাগের এক ভাগ ( ১/৬) পাবেন এবং বাকী ওয়ারিশদের দেওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তাও পাবেন।
- আর যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান না থাকে তাহলে অন্যান্য অংশীদারদের দেয়ার পর বাকী সমস্ত সম্পত্তি পিতা পাবেন।
মাতার অংশঃ
মৃত ব্যক্তির মাতাও তিনভাবে ওয়ারিশ সম্পদ বা উত্তরাধিকার লাভ করতে পারেন-
- মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি, যত নিম্নেরই হউক, যদি না থাকে অথবা যদি পূর্ণ বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাই বা বোন থাকে তবে মাতা ছয় ভাগের এক ভাগ ( ১/৬) পাবেন।
- যদি মৃতের সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি, যত নিম্নের হউক না কেন, না থাকে এবং যদি একজনের বেশি ভাই বা বোন না থাকে তবে মাতা তিন ভাগের এক ভাগ ( ১/৩) পাবেন।
- কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি, যত নিম্নের হউক না থাকলে অথবা কমপক্ষে দুইজন ভাইবোন না থাকলে এবং যদি মৃত ব্যক্তি স্বামী বা স্ত্রী হয়, তবে তার স্বামী বা স্ত্রী, মাতা ও পিতা উত্তরাধিকারী হলে সেই স্বামী বা স্ত্রীর অংশ বাদ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার তিন ভাগের এক ভাগ ( ১/৩) মাতা পাবেন। মৃত ব্যক্তির এক ভাই থাকলেও মাতা ১/৩ অংশ পাবেন।
ছেলের অংশঃ
ছেলে সকল অবস্থায় মৃত বাবার সম্পত্তির অংশ পাবে।
এছাড়া মৃত ব্যক্তির সকল সম্পত্তি আইন অনুযায়ী ভাগের পর যে সম্পদ অবশীষ্ট থাকে তাহা সবই ছেলে-মেয়েরা পাবে। এক্ষেত্রে অবশিষ্ট সম্পত্তি ছেলে যা পাবে মেয়ে তার অর্ধেক পাবে। তবে মৃতের কোন কন্যা যদি না থাকে তাহলে বাকী সম্পত্তি সব ছেলে পাবে।
মেয়ের অংশঃ
মৃতের কন্যা বা মেয়ে তিনভাবে ওয়ারিশ সম্পদের অধিকারী হয়। যথা-
- কন্যা একজন থাকলে সমস্ত সম্পদের দুই ভাগের এক ভাগ (১/২) পাবে।
- আর কন্যা যদি একাধিক থাকে, তাহলে সকল কন্যা মিলে মোট সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ (২/৩) পাবে।
- পুত্র ও কন্যা উভয় থাকলে একজন পুত্র যা পাবে একজন কন্যা তার ভাইয়ের অর্ধেক (১/২) পাবে।
স্বামীর অংশঃ
একজন স্বামী তার মৃত স্ত্রীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি দুই ভাবে পাবে-
- যদি মৃতের কোন সন্তান থাকে তাহলে মোট সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ (১/৪) পাবে।
- আর যদি মৃত স্ত্রীর কোন সন্তান না থাকে তাহলে মোট সম্পত্তির দুই ভাগের এক ভাগ( ১/২) পাবে।
স্ত্রীর অংশঃ
একজন স্ত্রীও তার মৃত স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি দুই ভাবে পাবে-
- মৃত ব্যক্তির এবং তার স্ত্রীর সংসারে কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকে তাহলে স্ত্রী মোট সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ (১/৮) পাবে।
- আর যদি মৃত ব্যক্তির এবং তার স্ত্রীর সংসারে কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তান না থাকে তাহলে স্ত্রী মোট সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ (১/৪) পাবে।
শেষ কথাঃ
ওয়ারিশ সম্পত্তির বন্টন আইন একটু জটিল বিষয়। উপরের লেখাটি আপনি সম্পূর্ণ পড়লে আশা করি যে, মৃতের সম্পত্তি হিসাব সহজেই বের করতে পারবেন। এছাড়া যারা একেবারে ওয়ারিশ সম্পত্তি বন্টন আইন বুঝতে পারেন না, তারা মুসলিম ফারায়েজ ক্যালকুলেটর এই ওয়েবসাইটি ব্যবহার করে এক মিনিটেই ওয়ারিশ সম্পত্তির হিসাব বের করতে পারবেন।