হেবা দলিল করার নিয়ম। জানুন হেবা দলিল কি?

হেবা দলিল বা হেবা সম্পর্কে আমাদের সমাজে নানা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য রয়েছে। অনেকেই জানতে চান হেবা সম্পর্কে। কে কাকে হেবা করতে পারবে, হেবার শর্ত কি? এবং হেবা দলিল করার নিয়ম এই বিষয়গুলো আমরা অনেকেই জানিনা। আজকের আলোচনা উক্ত হেবা কি এবং হেবা বিষয়ক সম্পর্ক নিয়েই। চলুন আমরা বিস্তারিত ভাবে জেনে নেই, হেবা দলিল করার নিয়ম।

মৃত্যুর পর মানুষের রেখে যাওয়া সম্পত্তি ওয়ারিশদের মাঝে বন্টনের সময় যাতে কোন রকমে গণ্ডগোল বা হট্টগোল না হয়, সেই জন্য অনেকেই তার জীবদ্দশায় সম্পত্তি নিজের ওয়ারিশদের মাঝে হেবা করে দিয়ে যেতে চান। তাই নিজের সম্পত্তি নিজের উত্তরাধিকারদের মাঝে নিজের ইচ্ছে মত হেবা করে দেওয়া সম্ভব।

আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা জানার চেষ্টা করবো, হেবা কাকে বলে? হেবা দলিল কি? এবং হেবার শর্ত কি কি এবং কে কাকে হেবা করতে পারে, হেবা দাতা-গ্রহীতার যোগ্যতা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় নিয়ে। তো চলুন শুরু করা যাকন।

হেবা দলিল করার নিয়ম।

যেহেতু আমরা আজকে জানবো হেবা দলিল করার নিয়ম। তাই হেবা দলিল করার নিয়ম জানার আগে আমাদের যে বিষয়গুলো জানা থাকা দরকার সে গুলো আগে জেনে নেই। যেমন-

  • হেবা কি?
  • হেবা দলিল কাকে বলে?
  • এই হেবা দলিলের শর্ত কি কি?
  • কে কাকে হেবা করতে পারবে।
  • দাতা-গ্রহীতার যোগ্যতা।

হেবা কি?

আরবী শব্দ হেবা। বাংলায় বলা হয় দান। আর ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে Gift। দান,হেবা বা Gift যে নামেই বলিনা কেন বিষয় কিন্তু একটি।

কোনো মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে কোনো বিনিময় ব্যতিরেখে বা কোন রকমের প্রতিদান বা স্বার্থ ছাড়া কোনো সম্পত্তি হস্তান্তর করলে তাকে হেবা বলে। অন্য ভাবে বলা যায় যে- কোন মুসলমান যখন খুশি হয়ে অন্য কোন মুসলমানকে তার বৈধ সম্পত্তি বীনা শর্তে দান করে তখন তাকে হেবা বলে।

হেবা দলিল কাকে বলে?

যখন কোন সম্পত্তি কোন মুসলমান অন্য মুসলমানকে হেবা করে তখন শুধু ঘোষণার মাধ্যমেই শেষ করে। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রের আইন ইনুযায়ী এই হেবা ঘোষনাকে দলিলে রুপান্তরিত করে নির্ধারিত সরকারী ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে।

তাই যখন কোন হেবার ঘোষনাকে দলিলে রুপান্তরিত করে নির্ধারিত সরকারী ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হয়, তখন তাকে হেবা দলিল বলে।

এই হেবা দলিলের শর্ত কি কি?

হেবা সম্পন্ন করার জন্য তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাহা হেবার বা হেবা দলিলের শর্ত হিসেবে পরিচিত। শর্তগুলো হলোঃ

  1. দাতা কর্তৃক হেবার ঘোষণা।
  2. গ্রহীতা কর্তৃক হেবা গ্রহণ বা গ্রহীতার সম্মতি।
  3. দাতার দ্বারা দখল হস্তান্তর এবং গ্রহীতা কর্তৃক দখল গ্রহণ।

কে কাকে হেবা করতে পারবে।

বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে হেবার যে বিষয়টি নিয়ে বেশী বিভ্রান্তি তা হলো  কয় জন ব্যাক্তিকে হেবা করা যাবে। অর্থাৎ কে কাকে হেবা করতে পারবে। রেজিস্ট্রেশন আইন-১৯০৮, এর ধারা ৭৮এ (বি) নং অনুসারে হেবার ঘোষণা দলিলের মাধ্যমে মুসলিমরা যে সকল সম্পর্কের ক্ষেত্রে হেবা করা যেতে পারে তা নিম্নরূপঃ

  • সহোদর বা আপন ভাই-বোন।
  • পিতা-মাতা এবং তার ছেলে-মেয়ে।
  • সবামী-স্ত্রীর মধ্যে।
  • দাদা-দাদী এবং নাতী-নাতনীকে।
  • নানা-নানী এবং নাতী-নাতনীকে।

এই কয়েকটি সম্পর্কের মধ্যে সম্পত্তি বেবা বা হস্তান্তর করা যায়।

উপরের সম্পর্কের বিষয় গুলোকে যদি আমরা সরাসরি ব্যাক্তি হিসেবে চিহ্নিত করি তাহলে ১৫ জন ব্যাক্তি পাওয়া যাবে। যাদের মাঝে একে অপারকে হেবা করতে পারবে। যেমন-

  1. বাবা।
  2. দাদা।
  3. দাদী।
  4. মা।
  5. নানা।
  6. নানী।
  7. স্বামী-স্ত্রী।
  8. ছেলে।
  9. ছেলের ছেলে।
  10. ছেলের মেয়ে।
  11. মেয়ে।
  12. মেয়ের ছেলে।
  13. মেয়ের মেয়ে।
  14. ভাই।
  15. বোন।

অর্থাৎ উপরের ব্যাক্তিদের মাঝে হেবা করা যাবে।

দাতা-গ্রহীতার যোগ্যতা।

দাতার যোগ্যতা।

  • প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
  • সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হওয়া।
  • সম্পত্তি নিজের বৈধ হওয়া।
  • নিজের দখলে থাকা।
  • হেবা গ্রহীতাকে সম্পত্তির দখল বুঝিয়ে দেওয়া।

গ্রহিতার যোগ্যতা।

একজন মুসলিম তার সমগ্র  স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সে যে কোন ব্যাক্তিকে হেবা বা দান করতে পারেন। অর্থাৎ গ্রহীতার ক্ষেত্রে সাবালক, নাবালক, পুত্র, অপুত্র, স্বামী কিংবা স্ত্রী, ধনী-নির্ধন বালাই নেই, যে কাউকে দান বা হেবা করা যায় এবং তিনি বা তারা নির্বিবাদে হেবা বা দান গ্রহণ করতে পারেন।

আরো জানুনঃ

হেবা দলিল করার নিয়ম।

পূর্বে মুসলিম আইন অনুযায়ী হেবা ঘোষনা লিখিত এবং রেজিস্ট্রেশন করার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলো না। এমনকি হেবার ক্ষেত্রে দখল হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করতে মালিক বা গ্রহিতাকে নিশ্চিতের কোন বাধ্য বাধকতা ছিলো না।

অতঃপর ২০০৫ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১২৩ ধারা এবং একই সালের The Registration Act 1908–এর ১৭ ধারা সংশোধনের ফলে স্থাবর সম্পত্তির হেবা ঘোষানাকে দলিলে রূপান্তরিত করে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এখন থেকে যে কোন সম্পত্তি হেবা ঘোষনা করলে তা দলিলে রূপান্তরিত করে হেবা গ্রহিতাকে রেজিস্ট্রেশন করে দিতে হবে।

রেজিস্ট্রেশন করতে হেবা দাতার যা যা প্রয়োজন।

  • ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি একটি(অরিজিনাল NID কার্ড সাথে রাখতে হবে)।
  • পাসপোর্ট সাইজের ছবি এক কপি।
  • সম্পত্তির মালিকানার প্রমান পত্র।যথা-নামজারীপত্র, মূল দলিল এবং বিভিন্ন পর্চা।
  • হেবা দাতা নিজে রেজিস্ট্রেশন অফিসে উপস্থিত থাকা।

গ্রহিতার যা যা প্রয়োজন।

  • ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি একটি(অরিজিনাল NID কার্ড সাথে রাখতে হবে)।
  • পাসপোর্ট সাইজের ছবি এক কপি।
  • হেবা গ্রহিতা নিজে রেজিস্ট্রেশন অফিসে উপস্থিত থাকা। তবে বাধ্যতা মূলক নয়।

হেবা দলিল রেজিস্ট্রেশন করন।

দাতা-গ্রহিতার উপরোক্ত বিষয়ের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে একজন অভিজ্ঞ এবং সরকারী লাইসেন্স প্রাপ্ত দলিল লেখকের সাহায্যে দলিল লিখে স্থাবর সম্পত্তি যে থানায় অবস্থিত,সে থানার সাব-রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে নির্ধারিত ফি দিয়ে হেবা দলিল রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে।

দান বা হেবা দলিল রেজিস্ট্রেশন ফি।

  1. রেজিস্ট্রেশন ফিঃ ১০০ টাকা।
  2. ষ্ট্যাম্প শূল্কঃ ১০০০টাকা।
  3. স্থানীয় সরকার করঃ প্রযোজ্য নয়।
  4. উৎসে আয়কর (53H): প্রযোজ্য নয়।
  5. উৎসে আয়কর (53FF): প্রযোজ্য নয়।
  6. মূল্য সংযোজন কর (VAT): প্রযোজ্য নয়।
  7. ই ফিঃ ১০০ টাকা।
  8. এন ফিঃ প্রতি ৩০০ শব্দ বিশিষ্ট এক পৃষ্ঠা বা উহার অংশ বিশেষের জন্য ২৪ টাকা।
  9. এনএনফি(নকল নবিশগনের পারিশ্রমিক)ঃ প্রতি ৩০০ শব্দ বিশিষ্ট এক পৃষ্ঠা বা উহার অংশ বিশেষের জন্য ৩৬ টাকা।
  10. হলফনামাঃ ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে হলফনামা প্রিন্ট করে দলিলের সাথে সংযুক্ত করতে হবে।
  11. কোর্ট ফিঃ সম্পত্তি হস্তান্তর(এল.টি) নোটিশের আবেদনের সাথে ১০ টাকা মূল্যের কোর্ট ফি সংযুক্ত করতে হবে।

হেবা দলিলের ফিস পরিশোধের পদ্ধতি।

দলিল রেজিস্ট্রেশনের যাবতীয় ফিসাদি স্থানীয় সোনালী ব্যাংকের ট্রেজারী শাখায় জমা করতে হবেঃ

  • রেজিস্ট্রেশন ফি, ই ফি,এন ফি, একসাথে একটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে স্থানীয় সোনালী ব্যাংকের ট্রেজারী শাখায় কোড নং ১-২১৬১-০০০০-১৮২৬ এ জমা করতে হবে।
  • এনএনফি(নকল নবিশগনের পারিশ্রমিক) নগদে স্থানীয় রেজিস্ট্রেশন অফিসে জমা দিতে হবে।

হেবা বা দানপত্র দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে সবমিলিয়ে ১৫০০টাকা থেকে ১৬০০ টাকা খরচ হতে পারে। তবে দলিল লেখক বা ডিড রাইটারের পারিশ্রমিক ফি আলাদা দিতে হবে।

একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, হেবা যদি উপরের ১৫ শ্রেনির ব্যাক্তির মাঝে করা হয়, তাহলে দলিল খরচ উল্লেখিত খরচের সমপরিমান হবে। কিন্তু হেবা যদি ঐ ১৫ শ্রেনি ব্যাক্তির বাহিরে করা হয় তাহলে দলিল রেজিস্ট্রেশন খরচ সাধারন সাবকবলা দলিলের ন্যায় হবে।

হেবার প্রকারভেদ।

হেবা সাধারণত দুই প্রকার। যথা-

  1. সাধারণ হেবা (Simple Hiba )।
  2. হেবা-বিল-অ্যাওয়াজ (Hiba-bil-awaz)।

সাধারণ হেবা।

যে হেবায় আদৌ কোনো প্রতিদান বা বিনিময় নেই এবং দাতা অবিলম্বে দানকৃত সম্পত্তি গ্রহীতার কাছে হস্তান্তর করেন । অর্থাৎ এই হেবায় দাতা কোন বিনিময় বা মূল্য গ্রহন করতে পারবেননা।

হেবা-বিল-অ্যাওয়াজ।

হেবা-বিল-অ্যাওয়াজ হলো মূল্যের বিনিময়ে হেবা। প্রকৃতপক্ষে এবং দৃষ্টত এটি বিক্রয় সমতুল্য (as good as sale). এতে ক্রয় চুক্তির যাবতীয় উপাদানই বিদ্যমান। হেবা-বিল-অ্যাওয়াজ এর দুটি শর্ত অবশ্যই পালন করতে হবে। যথা-

  1. হেবা গ্রহিতা কর্তৃক বিনিময় মূল্য প্রকৃত বা বাস্তবিক পক্ষেই দিতে হবে।
  2. দাতার মালিকানা পরিত্যাগকরত দান করার আন্তরিক অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে হবে।

এই হেবার বিনিময় হিসেবে একটি পবিত্র কোরআন কিংবা জায়নামাজ ও একটা ‘তসবিহ’ উত্তম বিনিময় (Consideration)। তবে এর মান যাই হোক না কেন, কার্যত এটি পরিশোধ করতে হবে, শুধু মুখে বললেই হবে না।

শেষ কথা।

আমাদের সমাজে হেবা নিয়ে যতই বিভ্রান্তিমূলক তথ্য থাকুকনা কেন, আপনি যদি আমাদের এই আর্টিকেলটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েন তাহলে আশা করি হেবা সম্পর্কে আপনার আর কোন সন্দেহ সংশয় থাকবেনা।

About Author

AMINUL ISLAM

মোঃ আমিনুল ইসলাম। পেশায় একজন ব্যাংকার। চাকরির পাশাপাশি লেখা লেখির অভ্যাস থেকে ব্লগিং করা। এই ব্লগে বিভন্ন প্রযুক্তি , সরকারি সেবা, ব্যাংকিং, আইন ও নিয়ম কানুন, এবং ইসলামিক সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করেছি।

Leave a Comment