দলিল যার জমি তার গেজেট

অবশেষে অপেক্ষা চাওয়ার অবসান হয়েছে “দলিল যার জমি তার গ্যাজেট” এর। কারণ, ইতোমধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইং তারিখ জাতীয় সংসদে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিল–২০২৩’ পাস হয়েছে। আজকে এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা জানতে পারবো, দলিল যার জমি তার গেজেট কি। চলুন বিস্তারিত জেনে নেই, দলিল যার জমি তার গেজেট

আগে জনশ্রুতি ছিলো যে, দখল যার জমি তার। এটা নিয়ে অনেক সমস্যা ও হাঙ্গামা হতো। এমনকি মারামারি পর্যন্ত হতো। মামলা করলেও বলা হতো দখলে থাকলেই মালিকানা দখলদারের। এ নিয়ে মামলা চলত বছরের পর বছর। মামলা চালাতে গিয়ে অনেকে জমির মুল্যের চেয়েও বেশি খরচ হয়ে যেতো।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য অনেকদিন থেকে মানুষের একটা চাওয়া ছিলো যে, দখল যার জমি তার এই সমস্যা সমাধানের। যাতে এমন একটি আইন হয়, যার মাধ্যমে দখল যার জমি তার এই সমস্যা সমাধান হয়। অবশেষে বাংলাদেশ সরকার দলিল যার জমি তার এই আইন পাশ করে দখলদার সমস্যা সমাধান করেছে। এই আইনের মাধ্যমে একমাত্র দলিল যার নামে থাকবে, জমি তারই হবে। দখল যার থাকুক না কেন।

দলিল যার জমি তার গেজেট কি?

নিজের বসতবাড়ির বা জমি জমা নিয়ে একধরনের আইন প্রচলিত ছিলো। যে আইনে ছিলো, যদি কোন ব্যক্তি একটানা ১২ বছর তার বাড়ি বা জমিতে না থাকে বা দখলে না থাকে এবং সেই বাড়িতে যে ব্যক্তি বসবাস করে বা দেখভাল, রক্ষানাবেক্ষণ করে, ১২ বছর পর দখলদার বা দেখভালকারী ব্যক্তি  ঐ সম্পত্তির মালিকানা দাবী করতে পারবে।

আপনি যদি আপনার নিজের বাড়িতে একটানা ১২ বছর না থাকেন। এবং সেই বাড়িতে যদি একজন ভাড়াটিয়া বা অন্য কোন ব্যক্তি ১২ বছর থাকে। আর সে যদি আপনার সেই বাড়ি দেখভাল করে। তাহলে আপনার অবর্তমানে সেই ভাড়াটিয়া ব্যক্তি আপনার বাড়ির মালিকানা দাবি করতে পারবে।

বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই আইনের বিরোধিতা ও প্রতিকার চেয়ে আসছে। কেননা এই রীতিনীতির কারনে সম্পত্তি নিয়ে নানা সমস্যা ও জটিলতা দেখা দেয়। জনগনের দাবী অনুযায়ী অবশেষে গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইং তারিখ জাতীয় সংসদে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিল–২০২৩’ নামে দলিল যার জমি তার আইনটি পাস হলো।

জাতীয় সংসদে আইনটি ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইং তারিখ পাস হলেও আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয় ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইং তারিখ। যেখানে রয়েছে অপরাধের বিভিন্ন ধারা ও তার শাস্তির বিধান।

আরো জানুনঃ

দলিল যার জমি তার গেজেট

আমাদের দেশে অনেক সময় বিভিন্ন কারনে একজনের জমি অন্য জনে ভাড়া বা এমনিতেই ব্যবহার করে থাকে। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ব্যবহার করার ফলে যখন জমির মালিক ভাড়াটিয়া বা যিনি ব্যবহার করেন তাকে ছেড়ে দিতে বললে তখন দখলদার ব্যক্তি নানা তালবাহানা শুরু করে থাকে। এমনকি দখলদার ব্যক্রিকে সড়াতে জমির প্রকৃত মালিককে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়।

আমাদের দেশে অনেক বাড়িতে ভাড়াটিয়া দীর্ঘদিন থাকলেও তাকে সরাতে বাড়ির মালিককে বেশ বেগ পেতে হয়। ভাড়াটিয়া যদি একটু ক্ষমতাধর হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। বাড়ির মালিক তাকে মামলা ছাড়া সরাতে পারেননা। এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও সরকারেরর নতুন আইন কার্যকর সমাধান দিবে।

দখলে থাকলেই মালিক নয়, থাকতে হবে দলিলসহ জমির প্রয়োজনীয় দস্তাবেজ। যে সব দস্তাবেজের মাধ্যমে জমির মালিকানা দাবী করা যায়, তা হলো-

  • বৈধ দলিল বা ক্রয়কৃত দলিল।
  • ওয়ারিশ সূত্রে মালিকানা।
  • হেবা দলিল সূত্রে মালিকানা।
  • আদালতের আদেশের সূত্রে মালিকানা।
  • রেকর্ড সূত্রে মালিকানা।

তাই বৈধ দলিল বা আদালতের আদেশের মাধ্যম সহ উপরোক্ত দলিল/দস্তাবেজের সূত্রে মালিকানা বা দখলের অধিকার প্রাপ্ত না হলে কোনও ব্যক্তি কোনও ভূমি দখলে রাখতে পারবেন না। কোন জমির মালিকানা দাবী করতে হলে উপরোক্ত দস্তাবেজের অবশ্যই প্রয়োজন হবে।

ওয়েবসাইট ভিজিট।

যারা এই নতুন আইনের বিস্তারিত জানতে চান, তার অবশ্যই ভিজিট করতে পারেন এই ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিল–২০২৩ ঠিকানায় বা ওয়বেওসাইটে। এই ঠিনার ভিজিট করলেই প্রথম নিচের পেইজটি ওপেন হবে। এরপর স্ক্রল করে নিচের দিকে নামলেই গেজেটের আওতায় যা যা আছে তা দেখতে পাবেন।

দলিল যার জমি তার গেজেট

আবার ভূয়া দলিল বা প্রতারনার মাধ্যমে দলিল বা রেকর্ড করে জমি বা বসতবাড়ির মালিকানা দাবী করলেও মালিক হওয়া যাবেনা। অনেকে এই ধরনের প্রতারণা বা পেশি শক্তির বলে অন্যের সম্পত্তি দখলে নিয়ে থাকে। যাহা মূলত আইনত অপরাধ। এই সব অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধ কল্পে পাশ হয়েছে  ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিল–২০২৩

অতএব কোন জমির মালিক যদি এরকম সমস্যার সম্মুখিন হন, তাহলে সরাসরি বিবাদে না গিয়ে নতুন এই আইনের ধারায় মামলা করতে পারবেন। আদালতে মামলা করলে অবশ্যই তিনি তার অধিকার ফিরে পাবেন। তাই জমির সঠিক মালিকের দখলদার সরাতে মামলা করা উচিৎ। এতে যেমন তিনি ন্যায় বিচার পাবেন,তেমনি এই ধরনের দখলদারের পেশি শক্তি সমাজ থেকে উৎখাত হবে।

ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনে অপরাধ সমূহ।

এই আইনের অধীনে ৪ এর ১ উপধারায় অপরাধ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ভূমি হস্তান্তর, জরিপ, রেকর্ড হালনাগাদ করণ বা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নিম্ম লিখিত যে কোন কার্য,যে কোন ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হলে তাহা ভূমি প্রতারণা সংক্রান্ত অপরাধ বলিয়া গন্য হবে।

  • অন্যের মালিকানাধীন ভূমি নিজের মালিকানা বলে প্রচার করা।
  • তথ্য গোপন করিয়া কোন ভূমি, সম্পূর্ণ বা উহার অংশ বিশেষ, কোন ব্যক্তি বরাবর হস্তান্তর বা সমর্পণ করা।
  • স্বীয় মালিকানাধীন ভুমির অতিরিক্ত ভূমি বা অন্যের মালিকানাধীন ভূমি, যথাযথ মালিক থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়ে অন্যের কাছে হস্তান্তর বা সমর্পণ করা।
  • কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তি বলে মিথ্যা পরিচয় প্রদান করে, জেনে শুনে এক ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তিরুপে প্রতিস্থাপন করে কোন ভূমি আংশিক বা সম্পূর্ণ হস্তান্তর বা সমর্পণ করা।
  • মিথ্যা বিবরণ সংবলিত কোন দলিল স্বাক্ষর বা সম্পাদন করা।
  • যথাযথ কর্তৃপক্ষ কাছে মিথ্যা ও অসত্য তথ্য প্রদান করা।

উপরোক্ত কার্য  সমুহের যে কোন একটি যদি কোন মানুষের দ্বারা সংঘটিত হয় তাহা অবশ্যই অপরাধ হিসেবে ধরা হবে। আর যার দ্বারা এই অপরাধ সংঘটিত হবে তাকে অবশ্যই শাস্তির মুখাপেখি হয়ে হবে। নতুন এই আইনে উক্ত অপরাধের নানা শাস্তির বিধান রয়েছে। নিম্মে আমরা শাস্তির বিধান গুলো বিস্তারিতভাবে জানবো।

ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনে অপরাধ সমূহের শাস্তি।

ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনের অপরাধ সমূহ উপরে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ আইনের ৪ এর ১ উপধারায় উপরোক্ত অপরাধের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

উপরোক্ত অপরাধ যদি কোন ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হয় তাহলে অনধিক সাত বছরের কারাদন্ড ও অর্থদণ্ডে দন্ডিত হবে। তাই যদি কোন ব্যক্তি এইরুপ অপরাধ করে তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আইনের অধিনে মামলা করলে অপরাধী ব্যক্তিকে বিচারক অনধিক সাত বছরের কারাদন্ড ও অর্থদণ্ডে দন্ডিত করতে পারবেন।

অর্থাৎ অপরাধ যদি প্রমানিত হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অনধিক সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়া হবে। অথবা সাত বছরের কারাদন্ড এবং সাথে সাথে অর্থ জরিমানা দিতেও হতে পারে। বিচারক উভয় শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

শেষ কথা।

বাংলাদেশের মানুষের অনেক দিনের দাবী ছিলো “দলিল যার জমি তার” এই আইনের। যদিও সংশয় ছিলো এই ধরনের আইন আসলে হবে কিনা। অবশেষে বাংলাদেশ সরকার ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইং তারিখ জাতীয় সংসদে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিল–২০২৩ নামে দলিল যার জমি তার আইনটি পাস করেন। এতে অনেক ক্ষেত্রে ভূমি দস্যু,পেশি শক্তির দাপট কমে যাবে। সাথে সাথে প্রচলিত দখল যার জমি তার এই আইনটিও বাতিল হলো।

About Author

AMINUL ISLAM

মোঃ আমিনুল ইসলাম। পেশায় একজন ব্যাংকার। চাকরির পাশাপাশি লেখা লেখির অভ্যাস থেকে ব্লগিং করা। এই ব্লগে বিভন্ন প্রযুক্তি , সরকারি সেবা, ব্যাংকিং, আইন ও নিয়ম কানুন, এবং ইসলামিক সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করেছি।

7 thoughts on “দলিল যার জমি তার গেজেট”

  1. আসসালামু আলাইকুম, ১৯৯০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিদৃষ্ট মৌজায়, নিদৃষ্ট দাগে কোনো দলিল হয়েছে কিনা, দলিল হলে দলিল নং সম্পাদনের তারিখ, দাতা ও গ্রহীতার নাম জানতে হলে সাব-রেজিস্টার এর কার্যালয়ে ফি কি ভাবে প্রদান করতে হবে এবং ফি কত হতে পারে জানানোর অনুরোধ রইলো

    Reply
    • ওয়ালাইকুম আসসালাম। জনাব আপনি মৌজা নং এবং দাগ নম্বর নিয়ে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্টার অফিসের কোন সনদ প্রাপ্ত তল্লাশিকারকের মাধ্যমে তল্লাশি দিতে পারেন। তাতে খরচ পড়বে প্রতি বছরে সরকারী ফি সহ সবমিলিয়ে ৪০০-৫০০ টাকা। সুতারাং ১৯৯০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ৩৩ বছরে খরচ হবে সম্ভব্য ১৬,৫০০/- বা তার কমবেশি।

      Reply
    • আসসালামু আলাইকুম!
      আমাদের এলাকায় বাজারে আমার বাবা এবং আরেকজন মিলে ৪ শতাংশ জমি ক্রয় করে সমানভাগে ( ২ শতক করে)!
      দীর্ঘ ৩৫ বছর যাবৎ আমার বাবা সেখানে যায়নি এবং আমার বাবা মারা গিয়েছে!
      যতটুকু জানতে পেরেছি দলিলে এখনো আমার বাবার নাম আছে এবং সাব রেজিস্ট্রার অফিস থেকে তল্লাশিদিয়ে দেখা গেছে আমার বাবার নামে দলিল আছে! কিন্তু তা ভোগদখল বাকি ২ শতক এর মালিক করছে! এখন জমি টা কিভাবে আমরা ওয়ারিশ সূত্রে পেতে পারি!
      দলিল যার জমি তার এই আলোকে আমরা কি জমি ফেরত পাবো???

      Reply
  2. আসসালামু আলাইকুম অর রহমাতুল্লাহ। স্যার,
    আমি পৌরসভার মধ্যে ৪.৫ শতাংশ ভিটা জমি কবলা করি। উক্ত জমির উপর কিছু স্থাপনা রয়েছে। যাহা আমার দখলে আছে।যেগুলোর বিনিময়ে আমি টাকা পরিশোধ করিয়াছি। কিন্তু হঠাৎ করে কয়েকদিন আগে যাহার নিকট হতে জমি ক্রয় করি সে ব্যাক্তি বলছেন যে দলিলে স্থাপনা উল্লেখ নাই তাই আমি এসব বিক্রয় করি নাই। স্থাপনা বাবদ টাকা দাবি করতেছেন।
    এমতাবস্থায় আমার করনীয় কি।
    জমির দখল সুত্রে কি স্থাপনা পাওয়া যায় না।
    পরামর্শ চাচ্ছি

    Reply
    • ওয়ালাইকুম আসসালাম।
      জনাব,
      আপনার যেহেতু জমি দলিল করে নিয়েছেন এবং দখলেও আছেন, এখন ঐ জমির স্থাপনা যে আগের মালিকের তার প্রমান কি? এখন আপনি যদি আগের মালিককে তার দাবীকৃত স্থাপনা না দেন তাহলে তার নেওয়ার কোন অধিকার নেই। বিষয়টি সামাজিকভাবে মিমাংশা করলেই ভালো হয়। তবে সবচেয়ে উত্তম হতো দলিলে স্থাপনা উল্লেখ করে নিলে।

      Reply
  3. আসসালামু আলাইকুম!
    আমি ২০১৭ সালে দোহার জেলায় কিছু জমি ক্রয় করে রেজিষ্ট্রেশন করি। অনলাইনে নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করি। ২০২৩ সালে এসে জানতে পারি আমি যেই জমি দখল করে ভোগ করতেছি সেই জমি আমার দলিল ভুক্ত না। আর আমার দলিলে যে জমি তা অন্য জনের দখলে। এখন আমি কি করতে পারি / কোথায় গেলে আমি কিভাবে আমার জমি দখলে নিতে পারি।

    Reply
    • ওয়ালাইকুম আসসালাম।
      জনাব,যে ব্যাক্তি আপনার জমি দখলে নিয়েছে তার সাথে বসে তার দলিল চেক করুন। এরপর সামাজিক ও স্থানীয় ভাবে সমাধান করার চেষ্টা করুন। কেননা দলিল যার নামে সেই ভোগদখল করতে পারবে। যদি সামাজিক ভাবে সমাধান না হয় তাহলে দলিল নিয়ে আদালতে মামলা করতে পারেন।

      Reply

Leave a Comment