চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম

লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম হলো চেক। চেকের মাধ্যমে আমরা একে অপারের মধ্যে লেনদেন করে থাকি। সহজ ও ঝামেলা কম হওয়ায় চেকের মাধ্যমটি বেশিরভাগ মানুষ বেচে নেয়। আবার এ ক্ষেত্রে আনেকে প্রতারণার আশ্রায় নেয়। চেক প্রতারণা থেকে মামলা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আজকের আলোচনার বিষয় চেক ডিজঅনারের মামলা নিয়ে। চলুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেই, কিভাবে চেকের মামলা করবেন বা চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম ।

চেকের সংজ্ঞাঃ

Cheque ইংরেজী শব্দ। গ্রাহক কর্তৃক ব্যাংকের উপর টাকা পরিশোধের লিখিত আদেশকে চেক বলা হয়। অন্যকথায় ব্যাংকের উপর তার গ্রাহক কর্তৃক আদেশনামাই হলো চেক।

১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ৬ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, চেক হলো একটি বিল অব এক্সচেঞ্জ বা বিনিময় বিল। যেটি কোন নির্দিষ্ট ব্যাংকের উপর ড্র করা হয় এবং যা চাহিবামাত্র ছাড়া অন্য কোনভাবে পরিশোধযোগ্য নয়।

চেক ডিজঅনার কি?

চেক ডিজঅনার বলতে টাকা উঠোনোর জন্য ব্যাংকে চেক জমা দেয়া হলে ওই চেকটির বিপরীতে টাকা প্রদান করতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অস্বীকৃতিকে বোঝাবে।

কী কী কারনে চেক ডিজঅনার হয়?

  • অপর্যাপ্ত তহবিল।
  • চেকের মেয়াদ উত্তীর্ণ।
  • চেক প্রদানকারীর স্বাক্ষরের মিল না থাকা।
  • টাকার পরিমাণ অংকে এবং কথায় মিল না থাকা, ইত্যাদি।

চেক ডিজঅনার করার পদ্ধতিঃ

প্রথমত, প্রদানকৃত চেক টি অবশ্যই চেকে উল্লেখিত তারিখের ৬ মাসের মধ্যে ব্যাংকে উপস্থাপন করতে হবে। উপস্থানের দিনই ব্যাংক কর্তৃক উক্ত চেকটি  প্রত্যখাত (প্রত্যাখানের লিখিত বিবরণ সহ) হতে হবে। প্রত্যাখানের লিখিত বিবরণকে বলা হয় চেক ডিজঅনার স্লিপ।

এই চেক ডিজঅনার স্লিপ অবশ্যই আপনাকে ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করতে হবে। কেননা চেক ডিজঅনার মামলা করার প্রধান উপকরণ হলো উক্ত চেক ডিজঅনার স্লিপ।

আরো জানুনঃ

চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম

চেক ডিজঅনার মামলা করতে নিম্মোক্ত ধাপগুলো অবলম্বন করতে হবে। যথা-

  • লিখিত চিঠি দেওয়া।
  • ব্যাংকে গিয়ে চেক ডিজঅনার করা।
  • উকিল নোটিশ দেওয়া
  • নালিশি আদালতে মামলা দায়ের করা।

প্রথমঃ লিখিত চিঠি দেওয়া

চেক ডিজঅনার মামলা করার প্রথম ধাপ হলো চেক দাতাকে লিখিত আকারে চিঠি প্রদান করা। চিঠি দেওয়ার সময় টাকা পরিশোধের নির্ধারিত সময় দিতে হয়।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি চেক দাতা চেকে উল্লেখিত টাকা পরিশোধ করে তাহলেতো সমাধান হয়ে যাবে। আর যদি চেক দাতা টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয় তাহলে ব্যাংকে গিয়ে চেকটি উপস্থাপন করে ডিজঅনার করাতে হবে।

দ্বিতীয়ঃ ব্যাংকে গিয়ে চেক ডিজঅনার করা

চিঠির মাধ্যমে চেক দাতা টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে এর পরবর্তী কাজ চেকটি ডিজঅনার করা। চেক ডিজঅনার করার জন্য চেকে উল্লেখিত তারিখের ৬ মাসের মধ্যে ব্যাংকে গিয়ে চেকটি উপস্থাপন করতে হবে। কেননা একটি চেকের মেয়াদ হলো উল্লেখিত তারিখ থেকে ৬ মাস। ৬ মাস পর আর চেকের মূল্য থাকেনা।

তাই উক্ত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ব্যাংক গ্রহন না করার কারনে আদালতে Negotiable Instrument Act এর ১৩৮ ধারা অনুযায়ী আর টাকা দাবি করা যায় না।

তাই ৬ মাস এর ভিতর চেক এর টাকা তোলার জন্য ব্যাংক এ উপস্থাপন করতে হয়। এর পরে এই চেকের আর মূল্য থাকেনা।

তৃতীয়ঃ উকিল নোটিশ বা লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া।

প্রথম ধাপে লিখিত চিঠির মাধ্যমে চেকে উল্লেখিত টাকা পাওয়া না গেলে চেক ডিজঅনারের পর একজন অভিজ্ঞ আইনজীবির মাধ্যমে উকিল নোটিশ বা লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করতে হবে।লিগ্যাল নোটিশে চেক দাতাকে কমপক্ষে ৩০ দিনের সময় দিতে হয়।

লিগ্যাল নোটিশ নিম্মোক্ত ভাবে প্রদান করা যেতে পারে।

  1. নোটিশ গ্রহিতার হাতে সরাসরি নোটিশ প্রদান করা।
  2. ডাকযোগে চেক প্রদানকারীর বসবাসের ঠিকানায় প্রাপ্তি স্বীকারপত্র সহ নোটিশ প্রদান করা।
  3. সর্বশেষ কোনো জাতীয় বাংলা দৈনিকে নোটিশটি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ।

চতুর্থঃ মামলা দায়ের করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র।

  • মামলার আরজী/ দরখাস্ত।
  • লিগ্যাল নোটিশ এর ফটোকপি ।
  • লিগ্যাল নোটিশ প্রেরনের ডাক রশিদ এবং এ.ডি এর ফটোকপি।
  • মূল চেকের ফটোকপি।
  • চেক ডিজঅনার স্লিপ এর ফটোকপি।
  • অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র।

পঞ্চমঃ  নালিশি আদালতে মামলা দায়ের করা।

উপরের ধাপগুলো শেষ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে হয়। ম্যাজিস্ট্রেট মামলা আমলে নিয়ে বিবাদী বরাবর সমন ইস্যু করে থাকেন। ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ইস্যুকৃত সমন অনুযায়ী বিবাদী যদি হাজির না হয় তাহলে পেপারে বিজ্ঞপ্তি দিবেন।

তারপরও হাজির না হলে ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ারেন্ট দিবেন এবং আসামী ধৃত হলে বা সমন অনুযায়ী হাজির হলে মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত করে বিচারের জন্য যুগ্ন দায়রা জজের নিকট পাঠিয়ে দিবেন।

যুগ্ন দায়রা জজ কর্তৃক বিচারকালে চেক প্রতারণার বিষয়টি প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে দিতে পারেন সর্বোচ্চ ১ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা চেকের সমপরিমাণ বা তিনগুন অর্থদন্ড অথবা ঊভয়দন্ড ।

চেকে উল্লেখিত অর্থের ২ (দুই) বা ৩ (তিন) গুন অর্থ যদি জরিমানা বা অর্থদণ্ড প্রদান করেন তাহলে চেকে উল্লেখিত অর্থের অতিরিক্ত টাকাগুলো কে পাবেন? তার উত্তর হচ্ছে – অতিরিক্ত টাকা গুলো সরকারি কোষাগারে জমা হবে।

চেকের মামলা থেকে প্রতিকারের উপায়ঃ

দেখুন, আপনি যদি চেক মামলার মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে থাকেন। তাহলে উক্ত মামলা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো, স্থানীয় ভাবে উক্ত বিষয়টির মীমাংসা করা। তবে এই কাজটি যদি সম্ভব না হয়, তাহলে আপনাকে ভিন্ন উপায় অনুসরন করতে হবে।

সেজন্য আপনাকে অবশ্যই একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ অ্যাডভোকেট এর শরনাপন্ন হতে হবে। আর তার মাধ্যমে আপনি এই ধরনের চেক মামলার প্রতারনার হাত থেকে রেহাই পাবেন।

কিন্তু আপনি যদি নিজেই এই প্রতারনার সাথে যুক্ত থাকেন। তাহলে আপনি আইন অনুযায়ী দন্ডনীয় অপরাধমূলক কাজ করবেন।

তবে প্রতিকারের এমন দুইটি আইন রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে চেক মামলার প্রতারনা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। যথা-

  1. হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারা অনুযায়ী।
  2. মূল আইন – দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪০৬ এবং ৪২০ অনুযায়ী।

শেষ কথাঃ

তাই কোনো কারণে আপনি যদি চেক মামলায় প্রতারিত হয়ে থাকেন। তাহলে আপনি কিভাবে মামলা করবেন অথবা সেই মামলা থেকে কিভাবে প্রতিকার পাবেন। তা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

আশা করি উপরের আলোচনাটি মনোযোক দিয়ে পড়লে চেক ডিজঅনার মামলা সম্পর্কে আপনি সঠিক ধারণা পেয়ে যাবেন।

About Author

AMINUL ISLAM

মোঃ আমিনুল ইসলাম। পেশায় একজন ব্যাংকার। চাকরির পাশাপাশি লেখা লেখির অভ্যাস থেকে ব্লগিং করা। এই ব্লগে বিভন্ন প্রযুক্তি , সরকারি সেবা, ব্যাংকিং, আইন ও নিয়ম কানুন, এবং ইসলামিক সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করেছি।

Leave a Comment