মুসলিম আইনে সম্পত্তির বন্টন

হাদিসে এসেছে যে, আমদের প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেছেন,“উত্তরাধিকার আইন নিজে জানো ও অপরকে শেখাও, কেননা সকল জ্ঞানের অর্ধেক হল এই জ্ঞান”। কিন্তু আমরা মুসলিম হাওয়া সত্ত্বেও আমাদের অনেকেরই উত্তরাধিকার আইন বা ফারায়েজ সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। আজ আমরা আলোচনা করবো মুসলিম আইনে সম্পত্তির বন্টন। সুতারাং চলুন, জেনে নেই মুসলিম উত্তারাধিকারী আইন বা মুসলিম আইনে সম্পত্তির বন্টন।

ফারায়েজ কি?

মুসলিম উত্তরাধিকার আইন কুরআন,সুন্নাহ,ইজমা ও কিয়াসের উপর প্রতিষ্ঠিত। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের সূরা নিসার ৭ থেকে ১২ নং আয়াতে এব্যপারে সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। উক্ত বিধান মোতাবেক মৃত ব্যাক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তির বিলি বা বন্টনের নিয়মকে ফারায়েজ বলে।

মৃত ব্যাক্তির সম্পত্তি বন্টনের পূর্বের কাজ।

যদি কোন মুসলমান মারা যায় তাহলে তার সম্পত্তি উত্তারাধিকারীদের মাজে বন্টনের আগে কিছু আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। সেগুলো পালন করেই তার সম্পত্তি বন্টন করতে হবে। নিম্মক্ত কাজগুলো সু-সম্পন্ন করার পর উত্তারাধিকারীদের মাঝে সম্পত্তি বন্টন করা যাবে।

সাধারনত চার ধরনের কাজ সম্পন্ন করতে হয়। যথা-

  1. মৃত ব্যাক্তির সম্পত্তি থেকে তার দাফন কাফনের যাবতীয় খরচ করতে হবে।
  2. যদি সে জীবিত থাকা অবস্থায় কোন ধার-দেনা করে থাকেন তাও তার সম্পত্তি থেকে পরিশোধ করতে হবে।
  3. তার স্ত্রী বা স্ত্রীদের দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকলে তাহা সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে হবে।
  4. মৃত ব্যক্তি কোন দান কিংবা উইল করে গেলে তা প্রাপককে বুঝিয়ে দিতে হবে।

উপরোক্ত সব কাজগুলো মৃত ব্যাক্তির সম্পত্তি থেকে মিটিয়ে অবশিষ্ট সম্পত্তি ফারায়েজ আইন অনুযায়ী তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে।

মুসলিম আইনে সম্পত্তির বন্টন।

আমাদের বাংলাদেশে যেহেতু সুন্নি বা হানাফি মুসলমানদের অনুসারী বেশী কাজেই, নিম্নে হানাফী আইন মোতাবেক সম্পত্তির উত্তরাধিকার উল্লেখ করা হল-

হানাফি আইনে প্রাথমিক উত্তরাধিকারী মোট- ৬ জন। যথা-(১) পিতা,(২) মাতা,(৩) স্বামী,(৪) স্ত্রী,(৫) পুত্র,(৬) কন্যা। যারা কখনো সম্পত্তির ওয়ারিশ প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয় না। আজ আমরা উক্ত ছয়জন উত্তরাধিকারীদের নিয়ে তাদের প্রাপ্য অংশের বিবরণ তুলে ধরবো।

পিতাঃ

মৃত ব্যক্তির সম্পদের উপর তাঁর পিতা ৩ (তিন) ভাবে সম্পদ পাবেন।

  • মৃত ব্যক্তির পুত্র, পুত্রের পুত্র কিংবা পুত্রের পুত্রের পুত্র এভাবে যত নিচেই হোক না কেন যদি থাকে, তবে মৃত ব্যক্তির পিতা পাবেন সম্পদের ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬)।
  • মৃত ব্যক্তির পুত্র, পুত্রের পুত্র কিংবা পুত্রের পুত্রের পুত্র এভাবে যত নিচেই হোক না কেন যদি না থাকে, মৃত সন্তানের শুধু মাত্র কন্যা সন্তান বা তাঁর পুত্রের কন্যা সন্তান থাকলে তবে পিতা সন্তানের সম্পত্তির ১/৬ অংশ পাবেন।
  • যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান না থাকে,তবে মৃত ব্যক্তির বাকী অংশীদারদের দেয়ার পর অবশিষ্ট সকল সম্পত্তি পিতা পাবেন।

মাতাঃ

মৃত ব্যক্তির সম্পদের উপর তার মাতাও ৩ (তিন) ভাবে সম্পদ পাবেন।

  • মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নেরই হোক না কেন, থাকলে অথবা যদি মৃত ব্যক্তির আপন, পূর্ণ বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাইবোন থাকে তাহলে মাতা পোবেন (১/৬।
  • মৃত ব্যক্তির নিজের কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না কেন, যদি না থাকে এবং মৃত ব্যক্তির যদি একজনের বেশি ভাই বা বোন না থাকে তবে মাতা পাবেন ১/৩।
  • যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি, যত নিম্নের হউক না কেন, যদি না থাকে অথবা কমপক্ষে দুইজন ভাইবোন না থাকে এবং যদি মৃত ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী অংশ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার তিন ভাগের এক ভাগ ( ১/৩) মাতা পাবেন।

স্বামীঃ

স্বামী ২ ভাবে মৃত স্ত্রীর সম্পত্তির ভাগ পেয়ে থাকে। স্বামী কখনো তাঁর মৃত স্ত্রীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না।

  •  মৃত স্ত্রীর কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকলে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তির ১/৪ অংশ পাবে।
  •  মৃত স্ত্রীর কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তান কেউই না থাকলে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তির ১/২ অংশ পাবে।

স্ত্রীঃ

স্ত্রী বা স্ত্রীগন তার বা তাদের মৃত স্বামীর সম্পত্তি ২ (দুই) ভাবে পাবেন। কোন ভাবে তার বা তারা স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না।

  • মৃত স্বামীর কোন সন্তান বা তাঁদের পুত্রের সন্তান থাকলে স্ত্রী,স্বামীর সম্পত্তির ১/৮ অংশ পাবে।
  • যদি মৃত স্বামীর কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তান কেউই না থাকলে তবে স্ত্রী, স্বামীর সম্পত্তির ১/৪ অংশ পাবে।

বিঃ দ্রঃ স্ত্রী একাধিক হলেও সবাই মিলে ১/৪ অংশ সমান ভাগেই পাবে।

পূত্রঃ

মৃত ব্যক্তির ছেলে বা ছেলেরা সকল ক্ষেত্রেই সম্পত্তি পায়। যেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ছেলে ও মেয়ে রয়েছে সেই ক্ষেত্রে ছেলে বা ছেলেরা, মেয়ে বা মেয়েদের চেয়ে দ্বিগুন সম্পত্তি পাবে।

মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে মাতাপিতা ও স্বামী-স্ত্রী নির্দিষ্ট সম্পত্তি পাওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি ছেলে মেয়ের মধ্যে বন্টন করা হবে। তবে মেয়ে না থাকলে অংশীদারদের অংশ দেয়ার পর অবশিষ্টাংশভোগী হিসেবে বাকী সম্পূর্ণ সম্পত্তি ছেলে বা ছেলেরাই পাবে।

কন্যাঃ

মৃতের কন্যা ৩ (তিন) নিয়মে তার মৃত বাবার সম্পদ পেয়ে থাকে, যথা-

  • যদি মৃত ব্যক্তির একজন কন্যা থাকে, তবে সে সম্পদের দুইভাগের একভাগ (১/২) পাবে।
  • যদি মৃত ব্যক্তির একাধিক কন্যা থাকে, তবে সব কন্যা একত্রে তিন ভাগের দুই ভাগ সম্পত্তি পাবে।
  • যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা উভয়েই থাকে, তবে পুত্র যে পরিমাণ সম্পত্তি পাবে, কন্যা তাঁর অর্ধেক পাবে।

উপরোক্ত ছয় জন ছাড়াও দাদ,দাদী/নানী,পূত্রের কন্যা,বৈপিত্রেয় ভাই/বোন এরাও বিভিন্ন অবস্থায় মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির অংশিদার হয়ে থাকে।

কোন উত্তরাধিকারী সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে কোন সন্তানকে ত্যাজ্য বলে ধরা হয় না। ফলে সম্পত্তি থেকে তাকেও বঞ্চিত করা যায় না। তবে কোন ব্যক্তি রেজিস্ট্রিকৃতভাবে সম্পত্তি দান বা হস্তান্তর করে গেলে এবং সন্তানকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে সন্তানের অংশ উল্লেখ না করে গেলে ঐ সন্তান আর সম্পত্তি পাবে না।

সৎ ছেলে-মেয়ে, সৎ বাবা বা সৎ মায়ের সম্পত্তি পায় না। এছাড়া মৃত ব্যক্তির হত্যাকারী তার সম্পত্তির ভাগ পাবে না। এবংভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করলেও সম্পত্তির উত্তারাধিকারী  হয়না।

উপসঙ্গহারঃ

উপরের আলোচনা মনযোগ সহকরে পড়লে আশা করি আপনি সহজেই মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি তার উত্তারাধিকারীদের মাঝে বন্টন করতে পারবেন। এছড়া আপনি আরো সহজে হিসাব করার জন্য ব্যবহার করতে পারেন উত্তারাধিকার.বাংলা নামের এই ওয়েবসাইটটি। যেখানে আপনি প্রদত্ত ক্যাল্কুলেটর ব্যবহার করে ১ মিনিটেই মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির হিসাব করতে পারবেন।

About Author

AMINUL ISLAM

মোঃ আমিনুল ইসলাম। পেশায় একজন ব্যাংকার। চাকরির পাশাপাশি লেখা লেখির অভ্যাস থেকে ব্লগিং করা। এই ব্লগে বিভন্ন প্রযুক্তি , সরকারি সেবা, ব্যাংকিং, আইন ও নিয়ম কানুন, এবং ইসলামিক সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করেছি।

Leave a Comment