কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম

মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক বন্ধন তৈরি হয় বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে। সমাজের ছোট একটি অংশ হলো সংসার। স্বামী-স্ত্রী মিলে তৈরি হয় এই সংসার। কখনো কখনো বিভিন্ন কারণে স্বামী-স্ত্রীর এই মধুর সংসারে তৈরি হয় অশান্তি। এই অশান্তিই শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক পর্যন্ত। অনেকেই নিয়ম কানুন না জেনেই নিজের ইচ্ছে মতো তালাক দিয়ে অবশেষে জেল খাটেন। তাই আমাদের মধ্যে যারা তালাকের নিয়ম কানুন জানিনা তাদের এ সম্পর্কে জানা একান্ত দরকার। চলুন জেনে নেই কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম

পারিবারিক দাম্পত্য জীবনের মারাত্মক সমস্যার সর্বশেষ সমাধান হলো তালাক ব্যবস্থা। ইসলামী শরীয়তেও তালাক হলো নিকৃষ্ট ভালো কাজ। এই পথে যেতে হলে অনেক ভেবে চিনতে যাওয়া উচিৎ। কেননা আবেগ ও অতিরিক্ত ইমোশন নিয়ে অনেকে সবামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাকের পর্যায় চলে যায়। যা পরবর্তীতে আপছোচের বিষয় হয়ে যায়। তাই আমাদের অবশ্যই তালাকের আগে অনেক ভাবতে হবে ঠান্ডা মাথায়।

অতএব তালাকের আগে আমাদের জানা উচিৎ তালাক কি? এবং তালাকের শর্ত কি? দাম্পত্য কলহের কোন পর্যায় গেলে তালাকের ব্যবস্থায় যাওয়া যায়। চলুন আমরা কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম জানার আগে তালাকের অন্যান্য বিষয়গুলো জেনে নেই।

তালাক কি?

আরবী শব্দ তালাকের অর্থ বিচ্ছিন্ন করা, ত্যাগ করা, আলদা করা ইত্যাদি। যার ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো Divorce। ইসলাম ধর্মে তালাক বলা হয় বিবাহ বন্ধনের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদকে। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী যখন কোন বিশেষ কারনে আলাদা হয়ে যেতে চান বা তারা আর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে চাননা, তখন যে প্রক্রিয়ায় বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করা হয় তাকে তালাক বলে।

তালাকের শর্ত।

সাধারনত তালাক বা Divorce কারো কাম্য নয়। কিন্তু কোন বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ অনিবার্য হলে তখন স্বামী-স্ত্রীর যে কেউ একজন আরেকজনকে তালাক দিতে পারে। কিন্তু ইচ্ছেমতো তালাক বা Divorce দিলেই হবে না। এখানে কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলো মানতে হবে। 

যেমন বিয়ে নিবন্ধনের সময় নিকাহনামার ১৮ নম্বর কলামে যদি স্ত্রীকে ডিভোর্সের অধিকার দেওয়া থাকে তবে স্ত্রী ডিভোর্স দিতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে স্বামীর জন্য যে প্রক্রিয়া রয়েছে স্ত্রীর জন্য ও একই প্রক্রিয়া বিদ্যমান।

আর স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চান তাহলে উভয়ের পারস্পরিক সম্মতিতে বা সরাসরি কাজীর মাধ্যমে অথবা কোর্টের মাধমে তালাক দিতে হবে। এভাবে  নিম্মোক্ত আইনি প্রক্রিয়া আবলম্বন  করে সবামী-স্ত্রী একে অপরকে তালাক বা  Divorce দিতে হবে।

তালাক বা ডিভোর্সের আইনি প্রক্রিয়া।

স্বামী বা স্ত্রী একে অপরকে তালাক বা ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে প্রথমে স্থানীয় প্রশাসন তথা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে নোটিশ পাঠাতে হবে। আর সাথে সাথে স্বামী বা স্ত্রী কেও উক্ত নোটিশের একটি কপি পাঠাতে হবে। চেয়ারম্যান, বা মেয়র মহোদয় নোটিশ প্রাপ্তির পর থেকে ৯০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।

নীটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান, বা মেয়র মহোদয় উভয় পক্ষকে ডেকে সমজতার উদ্দেশ্যে একটি সালিসি বৈঠকের আয়োজন করবে। এ সালিসি পরিষদ দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করবেন।

উভয় পক্ষের মধ্যে সমজতা হলে পুনরায় তারা সংসারে চলে যাবে। আর যদি সমজতা না হয়, তাহলে ৯০ দিনের পর তাদের তালাক বা ডিভোর্স কার্যকর হয়ে যাবে। এছাপড়া যদি চেয়ারম্যান, বা মেয়র মহোদয় নোটিশ প্রাপ্তির পর সমজতার উদ্দেশ্যে কোন সালিসি বা উদ্যোগ গ্রহন না করেন, তাহলে ৯০ দিনের পর তালাক কার্যকর হয়ে যাবে।

কয় ভাবে তালাক দেওয়া যাবে।

তালাক সাধারনত তিনভাবে দেওয়া যায়। যথা-

  1. উভয়ের পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক।
  2. সরাসরি কাজীর মাধ্যমে তালাক।
  3. কোর্টের মাধমে তালাক।

উভয়ের পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক।

স্বামী- স্ত্রীর উভয়ের পারস্পারিক সম্মতিতে যদি তালাকের সিদ্ধান্ত হয় তাহলে উভয় পক্ষের লোকজন মিলে একটি সালিসি বৈঠক বসবে।  একই বেঠকে স্বামী স্ত্রীর সমজতার ভিত্তিতে স্ত্রীর প্রাপ্য দেনমোহর প্রদান ও ভরণ-পোষণ প্রদান পূর্বক তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ করে তা কাজীর মাধ্যমে রেজিস্ট্রারী করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোন নোটিশের প্রয়োজন নেই।

তবে স্ত্রী এই তালাকের পর বিবাহ করতে চাইলে তাকে ইদ্দতকালীন তিন মাস সময় অতিবাহিত করতে হবে। তিন মাস বা ৯০ দিন পরেই স্ত্রী বিবাহ করতে পারবেন। কাজী নির্ধারিত ফি নিয়ে তালাক রেজিস্ট্রি করবেন এবং ফি ব্যতীত প্রত্যয়িত কপি প্রদান করবেন।

সরাসরি কাজীর মাধ্যমে তালাক।

উভয় পক্ষ যদি সম্মতি হয়, তাহলে সরাসরি কাজী অফিসে গিয়ে কাজীর মাধ্যমে তালাক প্রক্রিয়া কার্যকর করতে পারবেন। প্রথমে কাজী অফিসে গিয়ে কাজী সাহেবকে  তালাকের যাবতীয় ব্যবস্থা করতে বলতে হবে। কাজী সাহেব স্ত্রীর দেনমোহর সহ যাবতীয় পাওনা নিশ্চিত করার পর তালাকের কার্যক্রম শুরু করবেন।

অতঃপর কাজী সাহেব ফি নিয়ে তালাক রেজিস্ট্রি করবেন এবং ফি ব্যতীত প্রত্যয়িত কপি প্রদান করবেন। এক্ষেত্রে তালাক ৯০ দিনের পর কার্যকর হবে। আর এই নব্বই দিন বা তিন মসের ভরণ পোষন স্বামী স্ত্রীকে দিতে হবে।

কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম

মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হয়না। তবে নিকাহনামার ১৮ নম্বর দফায় বা কলামে স্ত্রীকে তালাক বা ডিভোর্স দেওয়ার অধিকার না দিলে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য স্ত্রীকে আদালতে আবেদন করতে হয়। ১৯৩৯ সনের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদের আইন অনুযায়ী স্ত্রী তার স্বামীকে Divorce  দিতে আদালতের কাছে আবেদন করতে হবে।

আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত যাচাই বাছাই করে আদেশ জারী করবেন। আদালতের আদেশের ৭(সাত) দিনের মধ্যে আদেশের সত্যায়িত কপি  আদালত তার নিজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে  সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যান বা মেয়রের ঠিকানায় পাঠাবেন। চেয়ারম্যান বা মেয়র যেদিন নোটিশ পাবেন, সেদিন থেকে ঠিক ৯০ দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে।

চেয়ারম্যান বা মেয়র সাহেব আদালতের আদেশের নোটিশ হাতে পাওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষকে নিয়ে একটি সালিসি বেঠক করে মীমাংসা করার চেষ্টা করবেন। যদি ৯০ দিনের মধ্যে তারা পূণরায় সংসারে ফিরে যেতে চায় তাহলে যেতে পারবে। আর যদি চেয়ারম্যান বা মেয়র সাহেব উভয় পক্ষকে মিলাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ৯০ দিনের পরেই তালাক কার্যকর হবে।

তালাক বা ডিভোর্সের খরচ কত?

মুসলিম বিবাহ ও তালাক বিধিমালা ২০০৯-এর ২১ বিধি অনুযায়ী তালাক নিবন্ধনের জন্য ৫০০ টাকা ফি গ্রহণ করতে পারবেন রেজিস্ট্রার। নকল প্রাপ্তি ফি ৫০ টাকা, যাতায়াত বাবদ প্রতি কিলোমিটার ফি ১০ টাকা ও তল্লাশি ফি ১০ টাকা গ্রহণ করতে পারবেন। আর এই তালাকের ফি তাকে পরিশোধ করতে হবে, যার পক্ষ থেকে তালাকের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। এছাড়া বিবাহ-তালাক রেজিস্ট্রেশন ফি বিস্তারিত জানুন এই ঠিকানায়।

স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকলে তালাকের ব্যবস্থা।

স্ত্রী অন্তঃসত্তা থাকলে সন্তান জন্মের পরই তালাক কার্যকর হবে। অর্থাৎ স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে এই অবস্থায় স্বামী তালাকের নোটিশ যেভাবেই বা যে মাধ্যমে পাঠাক না কেন অথবা নোটিশের মেয়াদ ৯০ দিন অতিবাহিত হলেও তালাক কার্যকর হবেনা। যতক্ষণ না সন্তান জন্ম হবে। সন্তান জন্ম দেওয়া বা তালাক কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত স্ত্রীর সমস্ত ভরণ-পোষণ স্বামীকে দিতে হবে।

তাই প্রত্যেক স্বামীর উচিৎ মানবিক কারনে হলেও স্ত্রী গর্ভবতী থাকাকালীন অবস্থায় তালাক না দেওয়া। কেননা এই সময় স্ত্রীরা মানষিকভাবে অনেক দুর্বল থাকে। যদিও তালাক কার্যকর হয় সন্তান প্রসব করার পর। তারপরেও স্ত্রী গর্ভবতী থাকাকালীন অবস্থায় তালাকের চিঠি না পাঠানো উচিৎ।

শেষ কথা।

মুসলিম ধর্মে তালাক হলো একটি নিকৃষ্ট ভালো কাজ। একসাথে বসবাস করতে গেলে অনেক সময় বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু এটা তিক্ততার পর্যায় নেওয়া উচিৎ নয়। তাই স্বামী বা স্ত্রী উভয়কেই সবসময় সেক্রিফাইস করতে হয়। তাহলেই সংসার মধুর হয়। তাই আমাদের উচিৎ সমাজের এই নিকৃষ্ট ভালো কাজ তথা তালাক বা Divorce কে এড়িয়ে চলা।

About Author

AMINUL ISLAM

মোঃ আমিনুল ইসলাম। পেশায় একজন ব্যাংকার। চাকরির পাশাপাশি লেখা লেখির অভ্যাস থেকে ব্লগিং করা। এই ব্লগে বিভন্ন প্রযুক্তি , সরকারি সেবা, ব্যাংকিং, আইন ও নিয়ম কানুন, এবং ইসলামিক সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করেছি।

Leave a Comment