জমির নামজারি করার নিয়ম
আমরা জীবনের প্রয়োজনে জমি ক্রয় করে থাকি। কিন্তু জমি কেনার পর যে কাজটি আমাদের সর্বপ্রথম করতে হয় তা হলো জমির নামজারি। কিন্তু অনেকেই জানিনা যে জমির নামজারি করার নিয়ম। নামজারি বা মিউটেশন করতে গিয়ে অনেকে নানাভাবে প্রতারনার স্বীকার হচ্ছেন। তাদের জন্য আজিকের এই লেখাটি।
জমির নামজারি করার নিয়ম
তাই এই আর্টিকেলটিতে প্রথমে আমরা আলোচনা করবো জমির নামজারি কি? কখন নামজারির প্রয়োজন হয়? এবং এর নামজারির প্রয়োজনীয়তা। এর পর নামজারী করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং আবেদন পদ্ধতি। সবশেষে নামজারি আবেদন নামঞ্জুর হলে করনীয় এবং রিভিউ আবেদন। সুতারাং চলুন শুরু করা যাক
জমির নামজারি কী
জমির নামজারি কিভাবে করবো এটা সবার জানা উচিৎ। কিন্তু জমির নামজারী কিভাবে করবো তা জানার আগে আমাদের জানতে হবে জমির নামজারী কি? নামজারি’ বলতে-কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বৈধ পন্থায় ভূমি/জমির মালিকানা অর্জন করলে সরকারি রেকর্ড সংশোধন করে তার নামে রেকর্ড হালনাগাদ করাকেই নামজারি বলা হয়। কোনো কারণে জমি হস্তান্তর হলে সরকারী রেকর্ডে পুরোনো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নাম প্রতিস্থাপন করানোকে বলে মিউটেশন বা নামজারি। তাই এই লেখা থেকে আমরা জমির নামজারি কিভাবে করবো তাহা জানতে পারবো।
কখন নামজারির প্রয়োজন হয়
- জমির মালিকের মৃত্যুর কারণে উত্তরাধিকারদের নাম সরকারি রেকর্ডে রেকর্ডভুক্ত করতে নামজারী প্রয়োজন।
- জমি বিক্রি, দান, হেবা, ওয়াকফ, অধিগ্রহণ, নিলাম ক্রম, বন্দোবস্ত ইত্যাদি সূত্রে হস্তান্তর হলে নতুন ভূমি মালিকের নামে রেকর্ডভুক্ত করতে নামজারী প্রয়োজন।
- দেওয়ানী বা সিভিল কোর্টের রায় বা ডিক্রীমূলে মালিকানা লাভ করলে সে রায় বাস্তবায়ন করতে নামজারির প্রয়োজন হয়।
নামজারির প্রয়োজনীয়তা
১) শুধুমাত্র কোন দলিলের মাধ্যমে অর্জিত মালিকানার ভিত্তিতে অথবা ওয়ারিশ হিসেবে পিতা-মাতার জমিতে দখলসূত্রে থাকলেই সরকারি রেকর্ডে উক্ত ভূমিতে তাঁর মালিকানা নিশ্চিত হয় না। কোন ভূমিতে বৈধ ওয়ারিশ বা ক্রয়সূত্রে মালিক হবার পর সরকারী রেকর্ডে পূর্বের মালিকের নাম কেটে বর্তমান মালিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হয়, তাহলেই তার মালিকানা সরকার কর্তৃক নিশ্চিত হয়। আর এটিই হল নামজারি পদ্ধতি।
২) আপনি যদি ওয়ারিশ হিসাবে বা ক্রয়সূত্রে কোন জমির মালিক হন কিন্তু নামজারি না করান, তবে আপনার অজান্তে কোনভাবে এক/একাধিক দলিল সম্পাদন করে কোন স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি আপনার আগে নামজারি করে ফেলতে পারে। তাতে আপনি পরবর্তীতে নামজারি করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই সমস্যায় পড়বেন। বাস্তবক্ষেত্রে জটিলতা আরো বাড়তে দেখা গেছে যখন উক্ত স্বার্থানেষী ব্যক্তি অপর এক বা একাধিক ব্যক্তির নিকট ঐ জমি ইতোমধ্যে বিক্রয় করে ফেলেছে। বর্তমানে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব ক্ষেত্রে নানারকম মামলা মোকদ্দমার সৃষ্টি হয়ে থাকে যা দীর্ঘদিন যাবৎ অর্থ, সময় ও মানুষে-মানুষে সম্পর্কের অবনতি ঘটায়।
নামজারি করা না থাকলে শুধু একাধিক বিক্রয়ের আশঙ্কাই বিদ্যামান থাকেনা, পরবর্তীতে আপনার অর্জিত সম্পত্তিতে দখলে থাকলেও আপনার অবর্তমানে আপনার উত্তরাধিকারগণ উক্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবার আশঙ্কা থাকে।উপরোক্ত জামেলা এড়াতে আমাদের জমি কেনার পরপরই নামজারি করা একান্ত প্রয়োজন।
নামজারি আবেদনে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র
- মূল আবেদন ফরম্ (এটি বাধ্যতামূলক)
- ১ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি (একাধিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রত্যেকের জন্যও প্রযোজ্য) (বাধ্যতামূলক)
- সর্বশেষ খতিয়ান (যাঁর নিকট হতে জমি ক্রয় করেছেন বা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন তাঁর খতিয়ান) (এটি বাধ্যতামূলক)
- ২০ টাকা মূল্যের কোর্ট ফি (বাধ্যতামূলক)
- ওয়ারিশসূত্রে মালিকানা লাভ করলে অনধিক তিন মাসের মধ্যে ইস্যুকৃত মূল ওয়ারিশন সনদ (শুধুমাত্র ওয়ারিশগনদের জন্য বাধ্যতামূলক)।
- জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্মসনদ /পাসপোর্ট/জাতীয়তা সনদ (ওয়ার্ড কাউন্সিলর কর্তৃক ইস্যুকৃত) (বাধ্যতামূলক)
- ক্রয়সূত্রে মালিক হলে দলিলের সার্টিফায়েড/ফটোকপি (ক্রয়সুত্রে মালিক হলে বাধ্যতামূলক)
- বায়া/পিট দলিলের ফটোকপি (একাধিকবার উক্ত জমি ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকলে সর্বশেষ যার নামে খতিয়ান হয়েছে তার পর থেকে সকল দলিলের কপি প্রয়োজন হবে, অর্থাৎ বাধ্যতামূলক)
- চলতি বঙ্গাব্দ (বাংলা সনের) ধার্যকৃত ভূমি উন্নয়ন কর (এলডি ট্যাক্স) বা খাজনার রশিদ (বাধ্যতামূলক)
- আদালতের রায়ের ডিক্রির মাধ্যমে জমির মালিকানা লাভ করলে উক্ত রায়ের সার্টিফায়েড/ফটোকপি (বাধ্যতামূলক)
উল্লেখ্য, উপরোক্ত কাগজপত্রের সবগুলিই যে আপনার জন্য প্রয়োজন হবে, তা নাও হতে পারে। কোনভাবে আপনি মালিকানা লাভ করেছেন তার উপর নির্ভর করবে কোন্ কোন্ সংযুক্তি আপনার প্রয়োজন হবে।
জমির নামজারি করার নিয়ম
সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস থেকে নির্ধারিত আবেদনপত্র সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় দলিলাদিসহ আবেদন করতে হবে। নির্ধারিত জায়গায় জমির বিস্তারিত পরিচয় দিতে হবে। আবেদনে নাম, ঠিকানা, রেজিস্ট্রি ক্রয় দলিলের নম্বর ও সাল স্পষ্ট থাকতে হবে।
একই সঙ্গে মূল দলিলের অনুলিপি, ভায়া দলিল, পরচা বা খতিয়ানের অনুলিপি, ভূ-উন্নয়ন কর পরিশোধের দলিল, ওয়ারিশান সনদপত্র, বণ্টননামা (প্রয়োজন হলে) দিতে হবে। কোনো রায়ের কারণে নামজারি করতে হলে ডিক্রি বা রায়ের অনুলিপি জমা দিতে হবে। এছাড়া বর্তমানে অনলাইনের মাধ্যমেও নামজারী করা যায়। সেজন্য আপনাকে আবেদন করতে হবে এই লিংকে।
নামজারি আবেদন নাঞ্জুর হলে করনীয়
বিভিন্ন কারণে নামজারি আবেদন নামঞ্জুর হতে পারে। আবেদন নামঞ্জুর হলে প্রতিকারের সুযোগ রয়েছে। নামজারি নামঞ্জুর হলে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) আদেশের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ আছে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের (রাজস্ব) কাছে এবং তা করতে হয় আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের (রাজস্ব) আদেশের বিরুদ্ধে ভূমি আপিল বোর্ডে আদেশের ৯০ দিনের মধ্যে আপিল করা যায়।
রিভিউ আবেদন
যে কর্মকর্তা আদেশ দিয়েছেন, তাঁর বরাবরই রিভিউ করতে হবে। রিভিউ করতে হয় ৩০ দিনের মধ্যে। তবে রিভিউ আবেদন করা হলে আর আপিল করা যায় না। উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, জমির নামজারি করার নিয়ম বা কিভাবে জমির নামজারি করতে হয়।