জমির রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধন আবেদন করার নিয়ম

রেকর্ড সংশোধন বলতে পর্চা বা খতিয়ান সংশোধন বোঝায়। সাধারনত জমি জরিপ করার সময় বিভিন্ন ধরনের ভূল হয়ে থাকে। তাই জরিপের সময় যদি কোন ভুল পরিলক্ষিত হয় বা ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কেউ ভুল রেকর্ড তৈরি করে নেয় তবে তা কিভাবে সংশোধন করা যায় অথবা জমির রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধন করার নিয়ম কি সেটি নিয়েই আজকের এই আলোচনা।

ভূমি বা জমির রেকর্ড কি?

সরেজমিনে ভূমি জরিপ বা মাপজোক সম্পান্ন হওয়ার পর সরকার ভূমি রেকর্ড তৈরির কাজ আরম্ভ করে থাকে। জরিপের সময় কয়েকটি গ্রাম বা একটি গ্রামকে একেকটি মৌজায় ভাগ করা হয়। আর প্রতিটি গ্রামের (মৌজার) একটি মানচিত্র তৈরী করা হয়। এই মানচিত্রকেই মৌজা ম্যাপ বলা হয়। মানচিত্র বা মৌজা ম্যাপই হলো ভূমি রেকর্ডের ভিত্তি।

এই মৌজা ম্যাপ বা মানচিত্র প্রণয়নকে কিশ্তওয়ার বলা হয়। এই মানচিত্র সাধারণত ১৬ ইঞ্চি = ১ মাইল স্কেলে প্রণয়ন করা হয়। সরেজমিনে জরিপ কাজ সম্পন্ন করে প্রকৃত অবস্থা দেখে সমস্ত জমিকে প্লটে প্লটে ভাগ করা হয়। একে খানাপুরি বলা হয়। এতে জমির মালিকানা, আয়তন, জমির শ্রেণী, মালিকানায় অংশীদারির বিবরণ ও অবস্থা লিপিবদ্ধ থাকে।

জমির রেকর্ড সংশোধন কিভাবে করা যায়

সাধারনত ২৫-৩০ বছর পর পর সরকার সরাসরি ভূমি জরিপের মাধ্যমে রেকর্ড তৈরি করে থাকে। এগুলোতে ভুল পরিলক্ষিত হলে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট উপস্থাপনের মাধ্যমে রেকর্ড সংশোধন করা যায়। ভুল যদি সাধারন করণিক বা প্রিন্টিং জনিত হয় তাহলে সে ভুল সংশোধন সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসি ল্যান্ড এর মাধ্যমে আবেদন করে করা সম্ভব। এছাড়া মালিকানা বা দখলীয় কোন ভুল হলে তার সংশোধনের এখতিয়ার শুধু ভূমি সার্ভে আপিল বোর্ড,ভূমি সার্ভে আপিল ট্রাইবুনাল অথবা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এর উপর।

আরো জানুন অনলাইলে জমির খতিয়ান অনুসন্ধান

খতিয়ান কি?

খতিয়ান অর্থ হলো ‘হিসাব’। মূলত জমির মালিকানাস্বত্ব রক্ষা ও রাজস্ব আদায়ের জন্য জরিপ বিভাগ কর্তৃক প্রতিটি মৌজায় জমির এক বা একাধিক মালিকের নাম, পিতা বা স্বামীর নাম, ঠিকানা, দাগ নম্বর, ভূমির পরিমাণ, হিস্যা (অংশ), খাজনা ইত্যাদি বিবরণসহ যে ভূমি-স্বত্ব প্রস্তুত করা হয় তাকে খতিয়ান বা Record of Rights বলে।

খতিয়ানের সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য আপনি সরাসরি ভূমি মন্ত্রণালয়ের (ই-পর্চা  eporcha) এই https://www.eporcha.gov.bd/ ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে পারেন।

খতিয়ান সংশোধন করার নিয়ম

জমির রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধন নির্ভর করে সাধারনত রেকর্ডে বা খতিয়ানে কি ধরনের ভূল হয়েছে সে বিষয়বস্তুর উপর। রেকর্ড বা খতিয়ানে ভুল সাধারনত দুই ধরনের হয়। যথা-

  1. করনিক ভুল (Clerical Mistake)।
  2. জমির মূল মালিক এবং দখলদার হওয়া সত্ত্বেও যদি খতিয়ানে অন্যের নামে মালিকীয় এবং দখলীয় লিপিবদ্ধ হয়।

যদি জমির রেকর্ড বা খতিয়ানে উপরোক্ত ভুল থাকে তবে সংশোধনের জন্য ভূমি মন্ত্রনালয়ের‘আইন শাখা-০১’ এর, গত ২৩শে সেপ্টেম্বর,২০১৫ তারিখের নং-৩১.০০.০০০০.০৪২.৬৭.০৩১.১১.৮৪১ স্মারকে প্রচারিত ‘পরিপত্রে’ চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত রেকর্ড বা খতিয়ানের ভুল সংশোধনের জন্য নিম্মোক্ত ৩ ধরনের কর্তৃপক্ষের কথা বলা হয়েছে।

সহকারী ভূমি কমিশনার বা AC Land।

The State Acquisition and Tenancy Act, 1950 এর ৪৩ ধারা মতে,এবং প্রজাস্বত্ব বিধিমালা, ১৯৫৫ এর বিধি ২৩ এর উপবিধি (৩) অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত রেকর্ডের করনিক ভুল (Clerical Mistake) সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তা যিনি বর্তমানে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসি ল্যান্ড হিসেবে কাজ করেন তিনিই সংশোধন করতে পারেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবেদনের প্রেক্ষিতে বা প্রজাস্বত্ব বিধিমালা ১৯৫৫ এর ২২ বিধির উপবিধি (১) অনুযায়ী খতিয়ানে দৃষ্ট করণিক ভুল সংশোধনের জন্য প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর পূর্ববর্তী জরিপের কাগজপত্র,প্রাথমিক খাজনা বিবরণী, ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সংরক্ষিত খতিয়ানের কপি এবং ২ নং রেজিস্ট্রার পর্যালোচনা ক্রমে এবং তিনি যে ধরনের অনুসন্ধান প্রয়োজন মনে করেন,তা করে এরূপ করণিক ভুল সংশোধনের নির্দেশ দেবেন। ইউনিয়ন (ভূমি) সহকারী কর্মকর্তা কর্তৃক সংরক্ষিত খতিয়ান এবং ২ নম্বর রেজিস্ট্রার অনুযায়ী সংশোধন করার নির্দেশ প্রদান করত সংশোধনলিপির কপি সংশ্লিষ্ট পক্ষকে প্রদান করবেন।

সহকারী কমিশনার (ভুমি) কর্তৃক বিবেচনাযোগ্য করণিক ভুলের মধ্যে নামের বানানের ভুল, অংশের হিসেবে ভুল,দাগের ভুল, ম্যাপের সংঙ্গে রেকর্ডের ভুল,জরিপকালে বাবার মৃত্যুর কারণে সন্তানদের নামে সম্পত্তি রেকর্ড হবার কথা থাকলেও জরিপকারকদের ভুল বা অজ্ঞাত কারণে তা মূল প্রজা বা বাবার নামে রেকর্ড হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

এসব ক্ষেত্রে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে থেকে প্রতিবেদন পাঠানোর পর সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নোটিশ প্রদান করা হয়। তারপর একটি নির্ধারিত তারিখে উভয়পক্ষের শুনানি গ্রহণ ও দাখিলীয় কাগজপত্রাদি বিবেচনায় কোনো আপত্তি না থাকলে খতিয়ানের করণিক ভুল সংশোধনের আদেশ দেওয়া হয়। সংশোধিত আদেশ অনুসারে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা সংশোধিত খতিয়ান প্রস্তুত করে পেশ করেন এবং কানুনগো প্রয়োজনীয় রেকর্ড সংশোধন করেন।

সংশোধনের পুরো পক্রিয়া সম্পন্ন হতে সাধারণত সময় লাগে ৩০-৩৫ দিন। সরকারিভাবে সংশোধনের জন্য আবেদনের সাথে ২০/- টাকার কোর্ট ফি সংযুক্ত করতে হয়।

ভূমি সার্ভে আপিল বোর্ড

The State Acquisition and Tenancy Act, 1950 এর ১৪৯ ধারার (৪) উপধারা মতে, Board of Land Administration যে কোন সময় যে কোন খতিয়ানে বা চুড়ান্তভাবে প্রকাশিত সেটেলমেন্ট রেন্ট-রোলে অন্তরভুক্ত যথার্থ ভুল (Bonafide Mistake) সংশোধনের আদেশ দিতে পারেন। কিন্তু Board of Land Administration বর্তমানে বিলুপ্ত বিধায় এ ক্ষমতা সরকারের পাশাপাশি ভূমি আপিল বোর্ডের রয়েছে।

ভূমি সার্ভে আপিল ট্রাইবুনাল অথবা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ

ভূমি সার্ভে আপিল ট্রাইবুনাল অথবা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সর্বশেষ জরিপে প্রকাশিত খতিয়ানের বিষয়ে যে কোন আদেশ প্রদানে এখতিয়ারবান। জরিপ পরবর্তী স্বত্বলিপি গেজেটে চুড়ান্ত প্রকাশনার পর কোন সংশোধনীর দাবী থাকলে তা ভূমি সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, ভূমি সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচার্য” অর্থাৎ আপনার খতিয়ানে যে কোন ধরনের ভুল হোক না কেন, ভুলের ধরন অনুসারে উপরিউক্ত ৩ ধরনের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই তা সংশোধন সম্ভব।

জমির রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধন করার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট

জমির রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধনের জন্য আবেদন থেকে শুরু করে সংশোধনের শেষ পর্যন্ত যে সমস্ত কাগজ লাগতে পারে সেগুলো হলো-

  • সর্বশেষ নামজারি খতিয়ানের সত্যায়িত ফটোকপি/ সার্টিফাইড কপি।
  • মূল দলিলের ফটোকপি/ সার্টিফাইড কপি( প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।
  • আবেদনের স্বপক্ষের প্রমানপত্র। যেমন- ওয়ারিশ সনদপত্র।
  • ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রশিদ/খাজনা রশিদ।
  • আবেদনকারীর সদ্য তোলা এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
  • সংশ্লিষ্ট মৌজার এসএ ও বিএস মৌজা ম্যাপ।
  • আদালতের রায়/আদেশ/ডিক্রির সার্টিফাইড কপি(যদি থাকে)।
  • বিএস জরিপের মাঠপর্চা,ডিপি খতিয়ান ইত্যাদি।

শেষ কথা

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম, জমির জরিপকালে রেকর্ডে বা খতিয়ানে কি ধরনের ভুল হয়ে থাকে। এসব ভুল হলে আমাদের কি করনীয় এবং কি প্রক্রিয়ায়, কাদের কাছে আবেদন করা যাবে। আসা করি এই লেখাটি আপনি মনোযোগ সহকারে পড়লে সংশোধনের নিয়মটি বা কিভাবে সংশোধন করা যায় তাহা বিস্তারিত জানতে পারবেন।

About Author

AMINUL ISLAM

মোঃ আমিনুল ইসলাম। পেশায় একজন ব্যাংকার। চাকরির পাশাপাশি লেখা লেখির অভ্যাস থেকে ব্লগিং করা। এই ব্লগে বিভন্ন প্রযুক্তি , সরকারি সেবা, ব্যাংকিং, আইন ও নিয়ম কানুন, এবং ইসলামিক সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করেছি।

1 thought on “জমির রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধন আবেদন করার নিয়ম”

Leave a Comment