জমি ক্রয় করার নিয়ম

আমরা অনেকেই জমি ক্রয় করে থাকি। কিন্তু জানি না জমি ক্রয় করার নিয়ম। এঅবস্থায় যখন অসাধু/দালাল বা প্রতারকচক্র এসে কোনো অবুজ,আবেগী, আগ্রহী ক্রেতাকে “সস্তায় ভাল জমির’খবর দেন তখনজমি ক্রয় করার নিয়ম না জেনেই চলে যাই জমি কিনতে। যাতে হাত ছাড়া না হয় তার জন্য আগ্রহী ক্রেতা দ্রুত বায়না ও রেজিষ্ট্রি করে মূল্য পরিশোধ করে জমি দখল করতে যান।

এভাবে জমি ক্রয় করার নিয়ম না জেনে ক্রয়-বিক্রয় করলেই পরবর্তীতে বাজে বিপত্তী। তাই জমি ক্রয়ের পূর্বে আমাদের অবশ্যই জানতে হবে জমি ক্রয় করার নিয়ম। তাই যারা জমি কিনতে আগ্রহী তাদে র জন্য আজকের এই আর্টিকেলটি। চলুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেয়া যাক জমি ক্রয় করার নিয়ম।

জমি ক্রয় করার নিয়ম

একজন ব্যক্তি যখিন কোন ব্যক্তির পক্ষ থেকে জমি বিক্রয়ের প্রস্তাব পায় তখন নিম্মোক্ত ধাপ সমূহের মাধ্যমে যাচাই বাছাই করতে হবে।

  1. ডকুমেন্টস/কাগজ যাচাই
  2.  মালিকানা স্বত্ব যাচাই
  3. ভুমির মালিকানার উৎস যাচাই
  4. দখল স্বত্ব যাচাই

জমির নিম্মোক্ত ডকুমেন্টস/কাগজ যাচাই

জমি ক্রয় করার নিয়ম এর প্রথম কাজ হচ্ছে ডকুমেন্টস/কাগজ যাচাই করা। আর ডকুমেন্টস/কাগজ যাচাই এর জন্য নিম্মের দলিল/পর্চা বুজে নিতে হবে-

  • মূল দলিল/মূল দলিলের সারটিফাইড কপি মূল দলিলের রশিদ সহ।
  • মূল দলিলে উল্লেখিত সমস্ত বায়া দলিল।
  • বায়া দলিলে উল্লেখিত অন্যান্য দলিল(যদি উল্লেখ থাকে)।
  • সি.এস পর্চা।
  • এস.এ পর্চা।
  • আর.এস পর্চা.
  • বি.এস পর্চা(যদি হয়ে থাকে)।
  • মহানগর জরিপ/সিটি জরিপ পর্চা(যদি মহানগরীর মধ্যে হয়)।
  • সবশেষ মালিকানাধীন ব্যক্তির নামজারী বা মিউটেশন পর্চা।
  • ডি.সি.আর বা ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ
  • হাল সন পর্যন্ত বা চলতি বছরের খাজনা রশিদ।
  • মৌজা ম্যাপ।

উপরোক্ত দলিল ও পর্চা সমূহ বুজে  নিয়ে ভালো করে যাচাই বাছাই করতে হবে। প্রয়োজনে ভূমি বিষয়ে অভিজ্ঞ, সৎ ও নিষ্ঠাবান আইনজীবির পরামর্শ নেয়া উচিত।

মালিকানা স্বত্ব যাচাই

জমি ক্রয় করার নিয়ম এর ডকুমেন্টস/কাগজ যাচাই করা যেমন জরূরী তেমনি জমি ক্রয়ের পূর্বে ক্রেতা কর্তৃক মালিকানা স্বত্ব যাচাই করার ক্ষেত্রে নিম্মোক্ত বিষয় গুলো যাচাই বাছাই করে দেখা আবশ্যক।

১। জমি বিক্রেতার প্রকৃত মালিকানা স্বত্ব আছে কিনা।

২। মালিকানার প্রমাণ হিসেবে বিক্রেতার নামে সর্বশেষ জরিপের এস,এ রেকর্ড অথবা আর,এস, রেকর্ড আছে কিনা। রেকর্ড/ খতিয়ানের মূল কপি বা সত্যায়িত কপি দেখে নিশ্চিত হতে হবে।

৩। বিক্রেতা যদি ক্রয় সূত্রে জমির মালিক হয়ে থাকেন তা হলে তার নামে মিউটেশন বা নামজারি করা হয়েছে কিনা।
৪। খাজনার দাখিলা যাচাই করা।

৫। বিক্রি প্রস্তাবিত জমির দাগ নম্বর এবং খতিয়ান নম্বর জেলা রেকর্ড রুমের রেকর্ড এবং উপসহকারী ভূমি অফিসের রেকর্ড যাচাই করে জমির মালিকানা সূত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। এছাড়া অনলাইনে পর্চা যাচাই করতে পারেন ই পর্চা খতিয়ান ওয়েবসাইটে

৬। অনেক সময় অসাধু দালাল ও ভূমি মালিক সরেজমিনে এক জমি দেখায় এবং রেজিষ্ট্রি করার সময় অন্য দাগ নম্বর রেজিষ্ট্রি করে দেয়। এ অবস্থা হতে পরিত্রাণ পেতে হলে রেজিষ্ট্রি করার পূর্বে রেকর্ড, নকশায় ও সরেজমিনে জমির দাগ নম্বর সনাক্ত করতে হবে।৭। কৃষি জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে রেকর্ডীয় মালিকানায় অংশীদারগণ অগ্রক্রয়াধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। সুতরাং অংশীদারদের সম্মতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।

৭। মালিকানা নিয়ে বিরোধ আছে এমন জমি ক্রয় করলে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে।

৮। বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে জমি বিক্রয়ের প্রস্তাব হলে তার মধ্যে সমস্যা নিহিত থাকার সম্ভাবনা বেশি। (সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিষ্ট্রার অফিস হতে জমির মূল্য এবং রেজিষ্ট্রি সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাবে)।

৯। শহর ও শহরতলীতে বিক্রির জন্য প্রস্তাবিত জমি সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বে অধিগ্রহণ হয়েছে কিনা অথবা অধীগ্রহণের প্রস্তাবাধীন কিনা তা সংশ্লিষ্ট অফিস হতে যাচাই করে দেখা আবশ্যক।

১০। জমির খাজনা/ ভূমি কর অনাদায়ে নিলাম হয়েছে কিনা তা যাচাই করা আবশ্যক।

১১। জমি সিকস্তি হওয়ার কারণে মালিকানা বিলুপ্ত হয়েছে কিনা তা যাচাই করা আবশ্যক।

১২। সংশ্লিষ্ট জমি সরকার বা কোন সংস্থাকে ঋণ গ্রহণের মর্গেজ দেয়া আছে কিনা তা যাচাই করা আবশ্যক।

১৩। বিক্রি প্রস্তাবিত জমিতে কোন বিরোধ বা মামলা মকদ্দমা আছে কিনা তা পার্শ্ববর্তী মালিকদের নিকট হতে অনুসন্ধান করে যাচাই করা যেতে পারে।

১৪। এজমালি তথা যৌথ মালিকানা সম্পত্তি ক্রয় করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মতি অথবা Power of Attorney(আমমোক্তার নামা) দেয়া আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া আবশ্য।

১৫। বিক্রয় প্রস্তাবিত জমি বিগত ৩০ বছরে কত বার হস্তান্তরিত হয়েছে তা সাবরেজিস্ট্রার অফিসে তল্লাশকারক দিয়ে যাচাই করা আবশ্যক। ইহা ছাড়া ভূমি মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইট এর মাধ্যমেও জমির মালিকানা সংক্রন্ত তথ্য জানা যেতে পারে।

ভুমির মালিকানার উৎস যাচাই

জমি ক্রয় করার নিয়ম এর মধ্যে ভুমির মালিকানার উৎস যাচাই করতে হবে অত্যান্ত গুরুত্ব দিয়ে। কেননা দেশের ভূমি মালিকানার বিরোধ অনেকাংশে ভূমি মালিকানার উৎসের সাথে জড়িত। তাই আমাদের মালিকানার উৎস অবশ্যই যাচাই করতে হবে। মালিকানার উৎস নিন্মোক্তভাবে হয়ে থাকে। যথা-

১.উত্তরাধিকার তথা ওয়ারিশ সূত্রে।

২. বিক্রয় ও ক্রয় সূত্রে।

৩.ভূমি বন্দোবস্ত প্রাপ্তির সূত্রে।

৪.নিলাম ক্রয় সূত্রে।

৫.সিকস্তি ও পয়স্তি সূত্রে।

৬.আদালতের রায় মূলে।

৭.ভূমি অধিগ্রহণ মূ।

৮.দান, ওয়াকফ, হেবা, উইল ইত্যাদি সূত্রে।

৯.লিজ বা ইজারা দলিলমূলে।

১০.বিনিময় বা এওয়াজ দলিলমূলে।

১১.বন্ধকী দলিল সূত্রে।

১২.১৯৫০ সালের জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৮৬, ৮৭, ৮৯, ৯০, ৯১, ৯২, ৯৩, ৯৪, ৯৫, ৯৬, ৯৭, ১১৭, ১৪৩ ও ১৪৪ ধারা মূলে।

দখল স্বত্ব যাচাই

জমি ক্রয় করার নিয়মের অন্যতম ধাপ হলো দখল স্বত্ব যাচাই। ডকুমেন্টস/কাগজ, মালিকানা স্বত্ব ও মালিকানার উৎস যাচাই এর সাথে সাথে সরেজমিনে একাধিকবার পরিদর্শনের মাধ্যমে দখল স্বত্ব যাচাই করা একান্ত প্রয়োজন। দখল স্বত্ব যাচাই ক্ষেত্রে নিম্মোক্ত বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

  1. দখলহীন মালিকদের জমি ক্রয় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এতে জমি দখলের জন্য দাঙ্গা ফ্যাসাদ এবং মামলা মকদ্দমায় জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই বাস্তবে জমিতে মালিকের দখল আছে কিনা তা সরেজমিনে দেখা।
  2. মালিকানা নিয়ে বিরোধ আছে এমন জমি ক্রয় করলে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। তাই মালিকানা নিয়ে বিরোধ আছে এমন জমি থেকে এরিয়ে চলতে হবে।
  3. পাশের জমির মালিকের সাথে সাক্ষাৎ করে মালিকানা স্বত্ব যাচাই করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরেজমিনে মৌজা ম্যাপ ব্যহহার করা যেতে পারে।

এভাবে উপরোক্ত বিষয়গুলো সঠিক ভাবে যাচাই-বাছাই করে জমি ক্রয় এবং জমি দলিল করার সাথে সাথে নতুন মালিকের নামে নামজারী/মিউতেশন করে দখলে যেতে হবে। তাই এসব বিষয় মাথায় রেখে আমাদের জমি ক্রয় করা উচিৎ।

About Author

AMINUL ISLAM

মোঃ আমিনুল ইসলাম। পেশায় একজন ব্যাংকার। চাকরির পাশাপাশি লেখা লেখির অভ্যাস থেকে ব্লগিং করা। এই ব্লগে বিভন্ন প্রযুক্তি , সরকারি সেবা, ব্যাংকিং, আইন ও নিয়ম কানুন, এবং ইসলামিক সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করেছি।

2 thoughts on “জমি ক্রয় করার নিয়ম”

Leave a Comment